গারোদের বিচার ব্যবস্থা অনুসারে প্রথমে সামাজিকভাবে বিচার বা সংশোধনের প্রচেষ্টা চালায়। এক্ষেত্রে গারো সমাজের দর্শন হচ্ছে- সকলকে নিয়েই সমাজ; দুটো কলসী একসাথে রাখলে যেমন মাঝেমধ্যে টুকোটুকি লাগে- তেমনই সমাজে একসাথে বসবাস করলে ছোটখাট ভুলত্রুটি মানুষের হতেই পারে। আর সকলের উচিত এই ভুলগুলোকে সংশোধন করে একতাবদ্ধ হয়ে বাস করা।
জাতিগতভাবেই গারোরা সৃষ্টিকর্তা এবং ধর্মের উপর ভীষণভাবে আস্থাশীল। অন্যান্য জাতির ভেতরে যে হারে পাপকর্ম বা অন্যায় অবিচার হয়, ধর্মীয় ভীতির কারণেই গারো সমাজে তুলনামূলকভাবে তা কম হয়ে থাকে। তারপরও গারোরা শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে এবং পারিপার্শিক পরিবেশথেকে দেখাদেখি অনেক অপরাধের তালিকা গারো সমাজেও প্রবেশ করেছে। তারপরোও গারোদের মধ্যে সরাসরি রাষ্টীয় আইনের দ্বারস্থ হয় না।
গারো সমাজে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি দোষ স্বীকার না করলে যেসমস্ত প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দোষ-নির্দোষ নির্নয় এবং বিচার সালিশ সম্পাদন করার প্রচলন ছিলো, তা সংক্ষেপে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
গারোদের বিচার ব্যবস্থা অতীত প্রেক্ষাপট
চিরিপ্পাঃ
চিরিপ্পা শাব্দিক অর্থে পানিতে ডুব দেওয়া। সাংসারেক ধর্মের খামাল (পুরোহিত) এবং এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করার জন্য বাদী-বিবাদী উভয়কে নির্দিষ্ট দিনে আহ্বান করেন। আগের দিন বাদী ও বিবাদীর নামে নির্দিষ্ট করে রাখা সকালে দুই খণ্ড ওয়া.গি (বাঁশ) সংগ্রহ করতে হয়।
বাঁশ কাটার সময় খামাল মন্ত্রপাঠ করেন। বাঁশগুলো নিয়ে আসার পর ডুব দিয়ে থাকার মতো গভীর পানিতে খামাল চুগারিয়া মাঞ্চি (মন্ত্র) পড়ে বাঁশটি পুঁতে দেন। তারপর অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত (বা তাদের প্রতিনিধিকে) দুজনকে সেই বাঁশের খুঁটি ধরে ডুব দিয়ে থাকতে হয়।
যে বেশি পানিতে ডুব দিয়ে থাকতে পারবে, তাকেই নির্দোষ বলে ঘোষণা করা হয়। আদিগারোদের বিশ্বাস অনুসারে, দোষী ব্যক্তির নামে যে ওয়াগি অর্থাৎ বাঁশের খণ্ডটি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, সেটি নাকি আগেই ফেটে যায়, অথবা মরে গিয়ে অকেজো হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, দোষী ব্যক্তি (বা প্রতিনিধি) চিরিপ্পা ক্রিয়াদির সময় পানিতে ডুব দিয়ে টিকতে পারবে না, তাকে পানির দেবতা পানিতে থাকতে দেয় না এবং পানির জীবজন্তু, বিষাক্ত পোকামাকড়, কাটাযুক্ত মাছেরা তাকে কামড়াবে বা দংশন করবে। বর্তমানে এই পদ্ধতিতে বিচারকার্য হতে দেখা যায় না।
ওয়া.ল সো.ওয়াঃ
ওয়া.ল সো.ওয়া মানে আগুন জ্বালানো। অর্থাৎ আগুন জ্বালিয়ে পানি সিদ্ধ করে এই পরীক্ষা করা করা হয়। এই পদ্ধতিতে বিচারের জন্যেও একইভাবে উভয় পক্ষথেকে একজন খামাল নির্ধারণ করা হতো।
প্রথমে খামাল চুগারিয়া মাঞ্চির পর কুমোর বাড়িতে বা বাজারথেকে মাটির হাঁড়ি একদামে (বা দর কষাকষি না করে) কিনে আনতে হতো। তারপর তিনটা জিগা গাছের ডাল কেটে চুলার আকারে মাটিতে পুঁতে দিতে তাতে হাঁড়িতে পানি ভর্তি করে একটি কাঁচা ডিম দিয়ে বসিয়ে দিতে হয়।
তারপর খামাল মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে চুলায় আগুন ধরিয়ে দেন। এই পদ্ধতিতে বিশ্বাস অনুসারে, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী হলে ক্রিয়াদির শুরু থেকেই ব্যঘাত ঘটতে শুরু করে। হাঁড়ির পানি ফুটলে এবং ডিম সিদ্ধ হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি দোষী সাব্যস্ত হতো। আর নির্দোষ হলে সেখানে যতোই আগুন জ্বালিয়ে রাখা হোক না কেন, পানিও ফুটবে না, ডিমও সিদ্ধ হবে না।
এভাবেই ওয়া.ল সো.ওয়া পদ্ধতিতে দোষী-নির্দোষ ব্যক্তির পরীক্ষা করা হতো। বর্তমানে এই পদ্ধতিতেও বিচারকার্য হতে দেখা যায় না।
মাতছাদো-মাতছাবেত বা আখ্রমঃ
বনের যেখানে বাঘেরা বসবাস করে বা চলাচল থাকে, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির নামে একটি মোরগ বা ছাগল বেঁধে রেখে আসতে হতো। প্রথমে লোকজনকে নিয়ে খামাল মাতছাদো-মাতছাবেত বা বনদেবতার নামে মন্ত্র পড়তে পড়তে পশুটি সারারাতের জন্য বেঁধে রেখে আসবেন।
সকালে বেঁধে রেখে আসা পশুটিকে যদি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যেতো, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিটিকে নির্দোষ বলে রায় প্রদান করা হতো। খামাল দিনেশ নকরেক বললেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিটি প্রকৃত দোষী হলে ক্রিয়াদির শুরুথেকে বিভিন্ন ধরণের বিপত্তি বা ব্যঘাত ঘটতে থাকে, যেমন- পশুটি আগেই ভয়/উৎকণ্ঠিত বা অসুস্থ্য হয়ে পড়া, বনের মধ্যে পশুপাখির ভয়ার্ত ডাকাডাকি, মানুষের হুঁচোট খাওয়া, আগেভাগে মাংসাশী জন্তুদের আনাগোনা ইত্যাদি।
পশুটি আক্রান্ত হলে বা মারা গিয়ে থাকলে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হবে এবং শাস্তি মেনে নিতে এবং জরিমানার দিতে বাধ্য থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতেও বিচারকার্য হতে দেখা যায় না।
মিকছেত্তাঃ
মিকছেত্তার অর্থ শপথ করা। অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য বিভিন্নভাবে শপথ নিতে হয়। যেমন,
- ১) নিজের দুই কান ধরে বা দুই কান চেপে, কণ্ঠনালী চেপে, দুই চোখ হাত দিয়ে চাপা দিয়ে, এবং শরীরের যেকোন অঙ্গ স্পর্শ করে (বিশ্বাস- দোষী হলে সাথে সাথে বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বধির, বোবা, অন্ধ, খোড়া বা পঙ্গু ইত্যাদি হয়ে যাবে);
- ২) দোষী হয়ে থাকলে হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণে তার মৃত্যু হবে বলে উচ্চারণ করে;
- ৩) নিজের অথবা সন্তানের মাথা ছুঁয়ে শপথ নিতে হতো। অপরাধের মাত্রা অনুসারে কত দিনের মধ্যে (মাস বা বছরও হতে পারে) হতে পারে তা খামাল নির্ধারন করেন।
শপথকারী যদি উক্ত সময়ে মধ্যে যদি শপথের পদ্ধতি অনুসারে নিজের অঙ্গহানি ঘটে, অথবা কোন হিংস্র জীবজন্তু দ্বারা আক্রান্ত হয়, অথবা কারোর মৃত্যু ঘটে; তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি দোষী সাব্যস্ত হবে।
এখনও কোথাও কোথাও ক্রোধের বশে এভাবে শপথ করতে শোনা যায়।