গারোদের উৎসবসমূহ সবগুলোই ঝুমচাষ কেন্দ্রিক। তাই চাষাবাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেবতাদের তুষ্টির জন্য, চাহিদামাফিক রোদ, বৃষ্টি, বায়ু এবং পোকামাকড়ের রোগ-বালাইয়ের হাতথেকে বাঁচার জন্য এই উৎসবগুলো পালিত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একমাত্র ওয়ানগালা উৎসবই হচ্ছে আনন্দের; অর্থাৎ ঘরে ফসল তোলার পরই এই উৎসব পালন করা হয়। এটি একটি নৈবেদ্যোৎসব ও নবান্ন উৎসব। এই দিনে গ্রামের সকলেই সং নকমার বাড়িতে একত্র হয়ে গরু, শুকর, মোরক দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে। এ উৎসবের সময়কাল ৩ থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। তাই গ্রামের সকলেই সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে চু-খাজি খেয়ে নাচগানের মধ্য দিয়ে আমোদ করে থাকে। অতএব, বলা যায় গারদের উৎসবগুলোর মধ্যে ওয়ানগালাই বড় উৎসব। এসময়ে যুবকযুবতীদের জন্য পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের কাজও চলতে থাকে।
ধান কাটার পূর্বে এবং ধান বা ফসলের জন্য বীজ সংগ্রহের পূর্বে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের জন্য উক্ত জমির কিছু অংশ পরিষ্কার করে সেখানে কলাপাতায় চিড়া, আখ/চিনি/গুড়, লেবু ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়। এসময় রাং বাজিয়ে আনন্দসহকারে নৃত্য পরিবেশন করে। সময়কালঃ আগস্ট মাস।
জুম ক্ষেতে চাষ হওয়ার সময় থেকে গারোরা রংচুগাল্লার স্বপ্ন দেখতে থাকে। রংচু শব্দের অর্থ চিড়া আর গাল্লা শব্দের অর্থ ফেলা। অর্থাৎ রংচুগাল্লা হচ্ছে চিড়াফেলার পূজা এবং আনন্দ উৎসব। রংচুগাল্লা উৎসবের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ; পুরাতন কাজকর্ম, মনের পুরাতন ভাবনা, ধ্যান-ধারণার নবীনীকরণ; এবং ধান বা অন্যান্য ফসলগুলো গোলায় তোলার আগে নতুন ফসলথেকে পরবর্তী বছরের জন্য উৎকৃষ্ট মানের বীজ বাছাই করে জমা রাখার শুভ সূচনা। তাই জুমক্ষেতের ধান কাটার সাথে সাথে রংচুগাল্লা উৎসবের আয়োজন করা হয়।
গারো চু বা মদ, ছবি: সংগৃহীত, ফেসবুক।
গারোদের আদি ধর্ম সাংসারেক বিশ্বাসীদের মতে, জগৎ স্রষ্টা মিদ্দি আপফা তাতারা-রাবুগার পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে পৃথিবী জুড়ে পানি আর বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিলো। তিনি পৃথিবীর আদিমানব মানব- শানী আর মুনিকে প্রথমে সৃষ্টি করলেন। শানি-মুনির বংশধর অর্থাৎ মানুষ শুরুথেকেই বনের ফলমূল, লতাপাতা এবং বনের পশুপাখি শিকার করে জীবন ধারণ করছিলো। পৃথিবীতে মানুষ বেড়ে যাওয়ায়- একসময় মানুষের বসবাসের জন্য স্থান সংকুলান এবং বনের ফলমূল, পশুপাখির অভাব হতে লাগলো। তাই বাধ্য হয়ে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে খাবার এবং বাসস্থানের সন্ধান করতে লাগলো। কিন্তু সেখানেও বনের ফলমূল, লতাপাতা এবং বনের পশুপাখি শিকার করে বেশীদিন চলতে পারলো না। তাই, তাদের খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ায় সকলে মিলে স্রষ্টার কাছে তাদের কষ্টের কথা জানালো। শস্যদেবতা দেবতা মিসি সালজং-এর দয়ায় মানুষ প্রথমে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করতে শিখে নিলো। যারা প্রথম চাষ করেছিলো তাদের নাম বনজাসকো এবং তার স্ত্রীর নাম জানেগানদো। তাদের মাধ্যমেই গারোরা এবং পরবর্তীতে সকল মনুষ্যজাতি চাষাবাদ করতে থাকে। গারোদের বিশ্বাস, মানুষের শ্রমের ফসলগুলো দেবতারা নানা প্রকার দুর্বিপাক, পোকামাকড় ও জীবজন্তুর হাত থেকে ফসল রক্ষা করেন। তাই, দেবতাদের তুষ্ট করতেই এই রংচুগাল্লার আয়োজন। এভাবেই খামাল দীনেশ নকরেক জানালেন- রংচুগাল্লার পৌরাণিক গল্পটি।
ছবি: সংগৃহীত, ফেসবুক।
তিনি আরোও জানালেন, একদিন আওয়াত_ফান্তি জেঙাত_মিচিক জমি থেকে ধান তুলে বাড়িতে নিয়ে আসছিলেন, এমন সময় রাস্তায় সালমাগিচ্চাক নামে এক মানুষরূপী দেবী চিংজিবিমা বলসালেকি জেংমিও দেখা দিলেন। দেখে বললেন, তোমরাতো শষ্যদেবী মা ফিলদির উপযুক্ত সম্মান না দিলে মারাত্মক অন্যায় করেছো (আইয়াও নাসঙো মারাং গাআহাজক, আমা ফিলদিখো গিদ্দকগ্রি দাক্কেতজক, নাচিলগ্রি ফিল্লেতজক), যার দয়া করুনায় ফসল পেলে, তাঁকে স্মরণ না করে কিভাবে ঘরে তা তুলতে চাও? তাঁকে এভাবে অসম্মান করার জন্য আমা ফিলদিকে পূজা দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে হবে (মারাং-খিপাতাংখো ওয়াতনা নাংনাজক)। তখন আওয়াত ফান্তি জেঙাত মিচিক ভয়ে জানতে চাইলেন কিভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে হবে। তখন দেবী জানালেন-
নাআদে নরমান্দিদে, দিমাঋষিদে,
মিখো সু.এসা, চুখো সং.এসা,
মান্দে থম্মেসা, বলথং চিল্লেসা,
আদুরি সিকবোনে, রাংখো খাকবোনে।
হি.সাল আক্কেসা, হি.চুখো আন্নেসা,
থি.মাচু আওয়াকখো চিনবোনে,
মিমা রংচুখো হন.বোন-আনবোনে,
আফা মিদ্দেখো মিং.এ, খা.সাখো মানবোনে।
চুবিচ্চিখো রুয়েসা, মারাংখো ওয়াতবোনে,
মিমামিসিখো, বিলসিনা বিৎচিরিখো,
নকগো গাতবোনে, জাম্মো দানবোনে।
মারাং ওয়াতগিজাদে, খিপাথাং জানগিজাদে,
বানা ফেং-এংনো, রিচ্চক সঙেংনো,
মারাং সক্কাংনো, খিপাথাং জান্নাংনো।
আদক বাত্তিংনো, চিবিল রোয়িংনো,
চিরিং চুওংনো, মারাং গাআংনো।
আপফা নকচামী, আমা আংসারি,
খাংনাবা নাসং, ওয়েনেংনাবা নাসং,
মারাং গানোয়া, খিপাথাং জান্নোয়া।
থাকরাক বিজাকখো, হি.সাল হি.চুখো,
আপফানা চিন্নেসা, মিদ্দেনা দান্নেসা
মারাং গালবোনে, খিপাথাং ওয়াতবোনে।
অর্থাৎ ধান কাটার পরে গোলাঘরে ফসল তোলার আগে তোমরা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করবে। তাঁকে পূজা দিবে। ঘরের ভেতর কলা পাতা বিছিয়ে সেখানে চাল, চিড়া, গুর, লেবু দিবে। তারপর চুবিচ্চি দিয়ে ফসলগুলোকে পবিত্র করে তারপর গোলায় ফসল তুলবে। এই পূজা না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা কেউই নতুন ফসল খাবে না, নদীর ওপারে যেতে পারবে না, দূরের কোন গ্রামে যাবে না, গ্রামের কোন বিচার শালিস, আনন্দ উৎসব করা যাবে না।
জানা যায়, আজও সাংসারেক গারোরা রংচুগাল্লা না হওয়া পর্যন্ত কেউ দূরের কোথাও বেড়াতে যান না, নতুন আত্মীয়তা কেউ গড়েন না, এমনকি শালিস বিচার কার্য, আনন্দ উল্লাস কেউ করেন না। তাই, সাংসারেকদের মাঝে আজোও রংচুগাল্লার আয়োজন করতে হয়। রংচুগাল্লা উৎসবের আয়োজনে সং নকমা (গ্রাম্যনেতা) দাকগুরা (চকিদার) এবং মাদ্দক (খামালের সহকারী)-কে দিয়ে সকলেই ধান কাটা সমাপ্ত করেছেন কিনা তা জানতে এবং প্রতিটি পরিবারকে চুমানচি, চু তৈরী করার জন্য বলতে গ্রামের সবার বাড়িতে গিয়ে পাঠিয়ে থাকেন। তারপর নতুন ধান কড়াইয়ে ভেজে রংচু বা চিড়া ভাজতে হয়- যাকে গারো ভাষায় মিমারংচু বলা হয়। সবকিছু প্রস্তুত হয়ে গেলেই সংনকমা রংচুগাল্লার অনুষ্ঠানের জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন।
রংচুগাল্লায় খামালের পূজার মন্ত্র-
ইয়াহৈ………
বানি মারিরাং, বানি খিপাতাং, সালমাং গিচ্চাকনে, সালমাং দুরিনে
আওয়াও রিওনবা.এ রামা দিংজি বিমাও
আওয়াত ফান্তিখো, জেঙাত মিচিকখো, রামা দিংদিবিমাও, বলসালেকি দিংমিও
গেরং আরিমুং, নামসাংআরিমুং, মিবাল অল্লাখো, জামনক্কো গাত্তাখো
হি.ওসা আগানজকনা, হি.ওসা খুস্রকজকনা, মিমা রংচুখো, থি.মাচু আওয়াকখো
হন.বো-চিনবোনে, হি.চা গালবোনে, মারিরাং গালবোনে, খিপাত্তাং ওয়াতবোনে।
আফা মিদ্দেখো মিংবোনে, খা.সাখো মানবোনে, উ.নাসা আঙাবা, খামাল রংজিফাবা নাংনা আন্নেঙা, নাংনা চিন্নেঙা। ইয়াহৈ………
শীঘ্রই গ্রামে সাজসাজ রব উঠে যায়। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনা, ঘরদোর হয়ে ওঠে ঝকঝকে পরিষ্কার। সবার পরিবারে নতুন ধান, চিড়া এবং চুবিচ্চির মম গন্ধ। দামা, রাং, আদুরি বেজে ওঠার প্রস্তুতি সমাপ্ত হলেই প্রথমে সংনকমার ঘরের মাঝখানে দুই ভাগে (দংরামা, আর নকজাংচি) কচি কলাপাতা দিয়ে বেদী সাজানো হয়। তাতে নতুন ধানের চিড়া, চিনি বা গুড়, লেবু বা লেবুর পাতা ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশে নৈবেদ্য প্রস্তুত হয়ে গেলেই খামালের নির্দেশে একসাথে দামা-বলথং, রাং, আদুরি, বেজে ওঠে। খামাল যথারীতি তার পূজার মন্ত্রপাঠ শুরু করে দেন। তারপর, গ্রামের সবার বাড়ি গিয়ে একইভাবে পূজা পর্ব পালন করা হয়। এইভাবে দামা-বলথং, রাং, আদুরির তালে তালে চু, খাজি খেয়ে খেয়ে, রেরে-আজিয়া গেয়ে গেয়ে রংচুগাল্লা উৎসব চলতে থাকে। এবছরে যদি কারোর বাড়িতে বাড়িতে নতুন খিম্মা এবং দেল্লাং থাকে, সেখানে মিদং বাঁধা হয়। সবশেষে সংনকমার বাড়িতে দামা-বলথং পুনরায় গুগাতার (রাখার) উদ্দেশে বড়সড় একটি ছাগল মেরে সবাইকে খাওয়ানোর মাধ্যমে তিনদিন ব্যাপী রংচুগাল্লা উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে। রংচুগাল্লা উৎসব আয়োজনের সময়কালঃ জামেদক জা অর্থাৎ আগস্ট মাস।
তথ্যসূত্র: দ্যা বিউটি অব গারোজ (The Beauty of Garos)