রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ব্লগসকবিরাজ এবং খামাল দীনেশ নকরেক এর স্বাক্ষাৎকার

কবিরাজ এবং খামাল দীনেশ নকরেক এর স্বাক্ষাৎকার

“কোনদিন খামাল-মাদ্দক হবো; আমার কল্পনাতেও ছিল না, স্বপ্নদিষ্ট হয়ে……।”

-খামাল দীনেশ নকরেক

বাংলাদেশে গারো সাংসারেক ধর্মের পুরোহিত কতজন আছে, তার সঠিক হিসাব কেউ জানে না। কারন গারো খ্রীস্টানদের মান্ডলিক কর্মকান্ডের মত ওঁরা প্রশাসনিকভাবে সুসংগঠিত নয়। অন্যান্য ধর্মের মতো সাপ্তাহিক ধর্মীয় সভা বা নামাজ গীর্জার মতো একসাথে বসে ধর্মীয় উপাসনার জন্য নির্ধারিত কোন দিন, তারিখ, স্থান নেই; তেমনই ধর্মীয় ‍উদ্দীপনার জন্য এদের কোন কার্য়ক্রম নেই।

বলাই বাহুল্য, সাংসারেক অনুসারীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় (উচ্চ) শিক্ষিত ব্যক্তি নেই বললেই চলে। আছে আদিমকালের সহজ সরল মন, চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ। এ রকম একজন ব্যক্তি সাংসারেক পুরোহিত বা খামাল দীনেশ নকরেক।

দীনেশ নকরেক এর স্বাক্ষাৎকার

গবেষণাধর্মী গ্রন্থ কার্য়ক্রমের পরিকল্পনানুযায়ী গারো সাংসারেক খামাল এবং কবিরাজ দীনেশ নকরেক এর একটা স্বাক্ষাৎকার নেওয়ার গভীর তাগিদ ছিল আমাদের। বোধকরি, নিন্মোক্ত প্রশ্নের মাধ্যমে আপনাদের আগ্রহ কিঞ্চিৎ পরিমান হলেও জানার আকাঙ্খা মিটবে। অনুসন্ধ্যানী দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ফিডেল ডি. সাংমা এবং তথ্য সহযোগি হিসেবে ছিলেন টুটুল চাম্বুগং এবং সবুজ ম্রং। পাঠকদের সুবিধার্থে গারো ভাষার স্বাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে হুবাহু দেয়া হলো-

গারো সংস্কৃতি মাধুর্য:

আপনি কেমন আছে ?

খামাল দীনেশ নকরেক:

আছি মোটামুটি, তোমরা….?

গা স মা:

জ্বী, আমরাও ভালো আছি। আমরা কিন্ত কথানুযায়ী আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আপনার সময় আছেতো ?

খা দী ন:

তোমরা বস। আমি কলকিতে আগুন নিয়ে। (কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই তিনি তামাক টানতে টানতে এসে বললেন)।

গা স মা:

আমরা আলাপ শুরু করতে পারি?

খা দী ন:

(একটু হেসে), হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু কর…

গা স মা:

প্রথমে আপনার নিজের মুখে আপনার পরিচয় জানতে চাই।

খা দী ন:

আমার নামতো তোমরা জানই। তবুও বলি। আমার নাম দীনেশ নকরেক। পিতার নাম রহিম সিমসাং, মায়ের নাম নয়জান নকরেক। আমার আচ্চু (দাদু) আগন চাম্বুগং, আম্বি (দাদী) সিলজী সিমসাং এবং নানা চক্কা মৃ (বাঙ্গালীদের জন্য নাম বিশ্বনাথ কবিরাজ), নানী চিংরি নকরেক। আমরা ছিলাম ৬ ভাই, ৩ বোন। আমি সবার বড় সন্তান। আমার ৫ ছেলে, ৩ মেয়ের মধ্যে নাতি-নাতনীর সংখ্যা ১১ জন।

গা স মা:

আপনার জন্ম কত সালে ?

খা দী ন:

আমার জন্ম তারিখ জানা নাই। তবে যে সময় বার্মা রেঙ্গুনের বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলো, তখন আমি প্রায় যুবক। বার্মায় যখন বৌদ্ধ মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছিলো, সে সময় আমিও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। আর সে সময় আমার বয়স লেখা হয়েছিল ১২ বছর (আমরা ইন্টারনেটের সহায়তা নিয়ে সার্চ করে দেখেছি, সময়টা ১৯৩৭ সালে, বার্মা স্বায়ত্ত শাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে। সে হিসাব মতে উনার বর্তমান বয়স ৮৮-৯০ বছর)।

গা স মা:

আমি জানি, আপনার জন্মস্থান এই ধরাটি গ্রামে না। আপনার আদি নিবাস সম্পর্কে বলুন।

খা দী ন:

আমাদের বাড়ি ছিলো বর্তমান শোলাকুড়ি ইউনিয়নের বাগাডোবা গ্রামে। আবার আমার ছোটভাই মৃত মিনেশ নকরে এর জন্মস্থান কিন্ত ঢাকার কমলাপুর রেওয়ে জংশ এর পূর্বদিকে ঝুপসি পাহাড় গ্রামে।

গা স মা:

কমলাপুরে গারো ছিলো ? ঢাকা সাভারে গারো বসবাস করে/করতো বলে শুনেছি, ঢাকা কমলাপুরের কথা কোনদিন শুনিনি কিন্ত!

খা দী ন:

হ্যাঁ, আমার জন্ম ওখানেই হয়েছে। সেখানে বেশিরভাগ মৃ, নকরেক এবং অন্যান্য মাহারী মিলে প্রায় ১৮টি পরিবার ছিলো। ঢাকার ভাওয়াল, শ্রীপুর হয়ে কমলাপুর, ঝুপসি পাহাড়, রাধা পাহাড়, মান্দা এবং সাভার পর্য়ন্ত গারো বসবাস করতো। শুনেছি, সেখানে আমার নানীর নামে ৬০ একরের মতো জমিজমা ছিলো (আমরা পরে নেটে সার্চ করে ঝুপসি পাহাড় নামে কোন জায়গা হদিস করতে পারিনি, তবে ওদিকে এখনো মান্দা নামে কোন এক জায়গা রয়েছে। মান্দার লোকজনদের সাথে আলাপ করে এলাকার নামাকরনের কারন জানা যায়নি)।

গা স মা:

মান্দি বা গারো বলতে আপনি কি বুঝেন ?

খা দী ন:

মান্দিতো আমরাই। আগেতো আমাদের মান্দিরা সবাই সাংসারেক ছিলো; এখন সবাই খ্রীষ্টিয়ান হয়ে গেছে। বাঙ্গালিদের সাথে দাঁড়ালে দেখেই বুঝা যায়; আমাদের সবারই চ্যাপ্টা নাক, গায়ের রং মোটামুটি ফর্সা, চোখ একটু ছোট, মান্দিরা নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। মান্দিদের আলাদা রীতি নীতিও আছে।

গা স মা:

মান্দিদের গোত্র কয়টি আপনি জানেন ?

খা দী ন:

অনেক। আচিক, আবেং, আত্তং, মেগাম আরো কত কি ! আর ঐ যে মান্দায়, হদি, টিপরা, হাজং, কচ্চু ওরাওতো আগে গারোই ছিলো। আদি গারোরা যাযাবর ছিলে বলে, খাবারের খোঁজে ছড়িয়ে পড়াতে, অনেকে আলাদা ধর্ম গ্রহন করাতে ওরা আলাদা জাতি হয়ে গেলো।

গা স মা:

গারোদের ভাষা কয়টি?

খা দী ন :

মান্দিদের যে কয়টি ভাগ আছে, ভাষাও ততটিই আছে। অনেকে কথা না বলতে বলতে তাদের ভাষাও ভুলে গেছে। আমি আগেই বলেছি, মান্দাই-হদিরাও মান্দিই ছিলো, আমাদের মান্দি ভাষার সাথে অনেকটাই মিল ছিলো, অথচ এখন তারা তাদের ভাষা জানেই না।

গা স মা:

মান্দি ভাষার কোন বর্ণমালা ছিলো কি ? মান্দিদের জন্য কোন বর্ণমালার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কি?

খা দী ন:

হ্যাঁ, ছিলো বলেইতো শুনেছি। তবে, ওটা নাকি ক্ষুধার জ্বালায় খারি সংথাত্তারি খেয়েছে, এজন্যেই আমরা বর্ণমালা হারিয়ে ফেলেছি। এখন আর সেই বর্ণমালা কোত্থেকে পাবে তোমরা?

গা স মা:

আগেকার মান্দিদের জীবন কেমন ছিলো, আর এখন কেমন ? সেসাথে মান্দিদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

খা দী ন:

আগেকার মান্দিরাতো এখনকার তুলনায় ভালোই ছিল। সেসময় মান্দিদের সহজ সরল জীবন যাপন করতো; এখনকার মতো জটিল, কুটিল ছিলো না। সবাই সবাইকে যথাযোগ্য সম্মান, সমীহ, স্নেহ দিয়ে চলতো, সং নকমা, খামালদের কথা সবাই মেনে চলতো। বড় কথা আসি মালজা কথাটি নিবিড়ভাবে মেনে চলতো।

এখনকার মতো সামান্য কারনে অহেতুক ঝগড়া ফ্যাসাদ, মনোমালিন্য হতো না, হলেও অল্পতেই মিটে যেতো। বনে জঙ্গলে বাসবাস করায় খাওয়া পড়ার জন্য তেমন ভাবনা ছিলো না। জুম চাষ করেই শ-শ মন ধান পেতো, ধানের গোলা ৪/৫ মাইল দুরে রাখলেও কেউ চুরি করতো না।

অভাবে সময় বনের আলু খেয়েই জীবন ধারণ করা যেতো। আগেকার দিনে মান্দিদের মধ্যে কামলার প্রচলন খুব বেশি ছিলো না, বারা রাগিকারি (প্রতিবেশির প্রয়োজনের সময় কাজ করে সাহায্য করে দিলে সে প্রতিবেশিও পরবর্তীতে কাজ করে দিবে। এতে টাকার কোন বিনিময় হয় না), রিমগ্রিমারি (মাংনা কামলা-গ্রাম/পাড়ার সকলে মিলে কাজ করে দেয়, তবে গ্রহস্থ তাদের জন্য খানাপিনার আয়োজন করে থাকেন) চলতো।

গ্রামে বা পাড়ায় কেউ বিপদে পড়লে সবাই এগিয়ে আসতো বড় ধরনের অসুখ বিসুখ হলে সকলেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাত জেগে পাহারা দিতো। তার মানে আমাদের মধ্যে কাসাগ্রিকা জিনিসটা ছিলো। এখন, মান্দিরা শিক্ষিত হচ্ছে, আর বাঙালিদের সাথে থেকে যত খারাপ কাজগুলোও শিখছে। কেউ কারোর কথা মান্যগণ্য করতে চায় না। এভাবে চলতে থাকলে অদুর ভবিষ্যতে মান্দিদের মধ্যে আর মান্দিত্ব থাকবে না, তোমরা দেখো।

গা স মা:

আদি গারোদের পারিবারিক জীবন কেমন ছিলো ?

খা দী ন:

ভালোইতো ছিলো। পারিবারিক বন্ধন খুবই দৃঢ় ছিলো। পরিবারের সকলেই মিলেমিশে একসাথে থাকতো। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই একসাথে থেকে, একে ওপরের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে পরিবারের ভালোর চিন্তা করতো।

কিভাবে ছেলেমেয়েদের সাংসারিক বিষয়ে শেখানো যায়, বিয়ের পর যেন শ্বশুর বাড়ির লোকদের কটু কথা শুনতে না হয়, সন্তানদের কারনে কারোর লজ্জা পেতে না হয়; তাই নিয়ে সচেতন থাকতে হবো। এখনতো সবাই গ্রিং-গিচ্ছাং (বিছিন্নভাবে) করে থাকতে পছন্দ করে। কেউ কাউকে সমীহ করে না, ধর্ম কর্মের দিকে মন নেই।

গা স মা:

আপনার বিয়েটা কিভাবে হয়েছিলো, যদি বলতে আপত্তি না থাকে।

খা দী ন:

(লজ্জা মেশানো হাসি দিয়ে) কেন আপত্তি থাকবে। আমার স্ত্রী মারা গেছেন। তাঁর অভিভাবকের পক্ষ থেকে যখন আমাকে জামাই নেওয়ার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসে, তখন আমি তাদের দারিদ্রতার কথা ভেবে রাজী ছিলাম না। ওরা খুব গরীব ছিলো। তবে, আমার বাবা মা সঙ্গত কারনেই রাজী ছিলেন।

একদিন সকালে খেয়ে বেড়াতে গেছি, সেখান থেকে ৪/৫ জন যোয়ান পুরুষেরা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে দ:বুক বিয়ে দিয়ে দিল। তারপর আমিও সে রাতেই ভোরের দিকে আরেকটা দরজা দিয়ে পালিয়েছিলাম।

তবে পরিচিত রাস্তায় আমাকে ধরে ফেলার ভয়ে ঘুরে আসতে গিয়ে বনের ভেতর দিক হারিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছতে পেরেছিলাম। পরে এক বছর পর আবার বুঝিয়ে সুজিয়ে এর সাথে সংসার করতে বাধ্য করে।

গা স মা:

আপনি মান্দিদের খাবারগুলোর মধ্যে কি কি খেতে পছন্দ করেন ?

খা দী ন:

খারি নাখাম, যেকোন মাছ, মাংস গপ্পা, উইথেবপা, ওয়াসিংÕও ব্রেঙা জংলি শাক পাতার ভর্তা ইত্যাদি।

গা স মা:

মান্দিদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাবারগুলো কি কি?

খা দী ন :

নাখাম, মাছ, শামুক, শুকর, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী, বনের পাখী, বিভিন্ন লতা পাতা ইত্যাদি।

গা স মা:

অনেকে বলেন, মান্দিরা নাকি লোহা ছাড়া সবই খায়। মানে সাপ, ব্যাঙ, পেঁচা, বাঘ, ভাল্লুক….।

খা দী ন:

মিথ্যে কথা। ওগুলো খেতো মাচ্ছিরা। মাচ্চিরা মানে, আমাদের মান্দিরাই একসময় দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে খাবারের অভাবে অনেক অনভ্যাস্ত ভাবারগুলোর খাওয়া শুরু করেছিলো। খিদের জ্বালাতো কারোর সয় না, তাই না?

গা স মা:

তাহলে বুলন মান্দিরা কি কি খায় না বা খেতো না ?

খা দী ন:

মান্দিরা বিশ্বাস করতো, মানুষ ঋণ নিয়ে মারা গেলে সেই ঋণ বাড়ি পাহাড়া দিয়ে ঋণ শোধ করার জন্য তাদের কারোর কারোর আত্মা কুকুর এবং বিড়াল হয়ে জন্ম গ্রহণ করে, তাই মান্দিরা বিড়াল কুকুর খেতো না। ব্যাঙ খেতো না কারন, ব্যাঙ-ই নাকি ওয়ানগালা কিভাবে করতে হয় ; তা শিখিয়েছে।

কেঁচো খেতো না, দেবতা কেঁচোকে পৃথিবী তৈরী করার জন্য মাটি আনতে পাঠিয়েছে। ময়ূর ঘরিরোয়া করতে শিখিয়েছে, কাঁক আমাদের স্বর্গ (চিকমাং) থেকে মুরগ মরগীর আর চুমান্থি/চুয়াঞ্চি এনে দিয়েছে। গেগাক/জংমেন (কাঠপোকা) দামা তৈরী করতে শিখিয়েছে, ভাল্লুক নাগ্রা দিয়েছে, বানর স্বর্গ থেকে বাঁশ, গরু, ছাগল এনে দিয়েছে। আরও এ রকম অনেক কাহিনী আছে।

গা স মা:

আপনার মতে সাংসারেক ধর্ম বলতে কি বুঝায়? আপনি কেন সাংসারেক ধর্ম বিশ্বাস করেন?

খা দী ন:

যারা তাতারা, রাবুগা, সুমিমে, সালজং, গয়েরা, কালকামেসহ প্রায় ৭০০০ দেবতাদের বিশ্বাস করেন, তারাই সাংসারেক। সাংসারেকরা পুনর্জম্মেও বিশ্বাস করেন। জীবিতকালীন ভালো কাজ করে মারা গেলে স্বর্গে (চিকমাং) যেতে পারবেন, আর মন্দ/পাপ কাজ করে মারা গেলে তাদের বিড়াল কুকুর, পশুপাখি হয়ে আবার জন্ম নিতে হবে। সে সাথে মিদ্দি আমুয়ার নিয়মকানুন, আসি মালজা ইত্যাদি যারা বিশ্বাস সহকারে মেনে চলবেন তারাই সাংসারেক।

গা স মা:

আপনি সাংসারেক ধর্মের কয়েকজন বড় বড় মিদ্দিদের নাম বলুন ?

খা দী ন:

তাতারা, রাবুগা, সুসিমে, সালজং, গয়েরা, কালকামে উনারাই বড় মিদ্দি।

গা স মা:

আপনার সাংসারেক খাঁটি ধর্ম এর পক্ষে আপনি যুক্তি দেখান।

খা দী ন:

আমি আমার মিদ্দিদের নিয়মিত পূজা দেই। মিদ্দিরা নাখোশ হলে মানুষের বিপদ হয়। আবার তাঁদের খুঁশি করতে পারলে উনারাও আমাদের প্রতিপালন করেন। একটা উদাহরণ দেই, কয়েকদিন আগে এক মুসলিম ছেলে এদিকে কামলা দিতে এসে আমার মোবাইল চুরি করে নিয়ে গেল। আমি জানতামই না, আমার মোবাইল কে বা কারা নিয়েছে। কিন্ত চোর সেটা এক রাতও রাখতে পারেনি, পরেরদিন খুব ভোরে এসে নিজে থেকে স্বীকার করে মোবাইল ফেরত দিয়ে গেল। আরেকট ঘটনা এ রকমই।

এক লোক আমাকে না বলে আমার বাগানের বেড়া থেকে রলা (বেড়া দেয়ার জন্য গাছের ডাল) কেটে নিয়ে বেড়া দেয়ার পরেও সেটা ফেরত দিয়ে গেলো। আসলে আমার অনুমতি ছাড়া আমার কোন জিনিস নেওয়াই যাবে না, বা যায় না। কারন, আমি আমার মিদ্দিদের বিশ্বাস করি, নিয়মিত পূজা করি। এভাবে যারাই আমাদের মিদ্দিদের বিশ্বাস করেছেন, তাদের সবাইকে মিদ্দিরা রক্ষা করে চলেছেন।

গা স মা:

তাহলে মান্দিদের সাংসারেক ধর্ম ত্যাগের কারন কি?

খা দী ন:

মান্দিরা খুবই সহজ সরল। তাই যারাই মান্দিদের ধর্মান্তরের জন্য বুঝিয়েছে, তাই বুঝেছে, মেনেছে। আমার মনে হয়, অতীতে বিভিন্ন রাজার আমলে মান্দিরা বাঁচার জন্য, টিকে থাকার জন্যেও অনেক ধর্মান্তরিত হয়েছে। যে কারনে হাজং মান্দাই-হদিরা আলাদা জাত হয়ে গেলো। আর এখনতো খ্রীষ্টান মিশনারীদের প্রচারের কারনে মান্দিরা প্রায় সবাই খ্রীষ্টান হয়ে গেছে।

গা স মা:

আপনি কি মনে করেন, মান্দিরা আবার সাংসারেক ধর্মে ফিরতে পারে ? কেন ?

খা দী ন:

এটা যার যার বিশ্বাস। তবে যখনই বড় বড় ডাক্তাররা রোগী ভালো করতে পারে না, তখনতো আমাকেই আমুয়ার জন্য ডাকে, মানে ডাকতে বাধ্য হয়। মান্দিরা এখনো গয়েরার জন্য ভয় পায়।

বজ্রপাত হলে আমাকে ডাকে পূজা দেওয়ার জন্য। ভয় পেয়ে অসুখবিসুখ হলে কেউ ডাক্তারের কাছে যায় না, আমার কাছে তেলপড়া নেওয়ার জন্য চলে আসে। এভাবেই সাংসারেক টিকে থাকবে।

গা স মা:

সাংসারেক ধর্মে ফিরতে হলে কি নতুন করে কোন ধরণের নিয়ম বা অবগাহন নিতে হবে?

খা দী ন:

না, সাংসারেক ধর্মে ফিরতে হলে নতুন কোন ধরণের নিয়ম বা অবগাহন নিতে হয় না, বিশ্বাস করলেই হবে।

গা স মা:

সাংসারেক ধর্ম টিকিয়ে রাখতে হলে সাংসারেকদের কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

খা দী ন:

জানি না। তার কার সাংসারেক অনুসারীরা ধর্মটাকে টিকিয়ে রাখার কথা কখনোই ভাবেনি। এভাবে কেউ বলেও নি, আমিও না। তবে আমার বিশ্বাস যে, সাংসারেক ধর্মটাকে নকগুবার (সৃষ্টিকর্তা) পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, এটা তাঁরই দান। তাই প্রকৃতি/পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন সাংসারেক ধর্ম টিকবে। মিদ্দিরাই এ ধর্মটাকে টিকিয়ে রাখবেন।

গা স মা:

আপনি কেন খামাল হলেন? আপনি এগুলো কার কাছ থেকে শিখেছেন ?

খা দী ন:

আমারতো খামাল হওয়ার কোন শিক্ষাগুরু নাই। আসলে আমি কোনদিন খামাল-মাদ্দক হবো, তা আমার কল্পনাতেও ছিলো না। ধর্ম নিয়ে আমি সেভাবে ভাবতামও না। সে জন্যেই বোধয় স্বপ্নে আমাকে ভয় দেখানো হতো। প্রায়ই কীসব অদ্ভুদ অদ্ভুদ আমি স্বপ্ন, দু:স্বপ্ন দেখতাম।

তাই আমি সাংসারেক ধর্মের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম। তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না, বাস্তবে আমার কোন শিক্ষাগুরু নেই। পূজা পার্বণে যা দেখেছি, তারপর বড় বড় খামালরাই স্বপ্নে আমাকে খামালের মন্ত্রগুলো শেখাতে লাগলো।

গা স মা:

আপনি খামাল হওয়ার পাশাপাশি কবিরাজিও করেন। কিভাবে আপনি কবিরাজ হলেন ? কোথায় এবং কার কাছে শিখেছেন ?

খা দী ন:

আমার আচ্চু বড়মাপের কবিরাজ ছিলেন। কিন্ত কবিরাজিতেও আমার কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা ছিলো না। আমাকে আমার এক বিশ্বস্ত লোক আরাগিসি খাইয়েছিল। ঔষধের জন্য আমি সারা বাংলা আর ইন্ডিয়ার অনেক জায়গা চষে বেড়িয়েছি। বলতে পারো, আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি।

তাই সেই কষ্ট থেকেই আমিও কবিরাজি করার প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে কবিরাজি শিখিয়েছেন, গাছাবাড়ির (মৃত) অনিলফা।

গা স মা:

সাধারণত আপনার কাছে কি রোগের চিকিৎসা করতে আসেন?

খা দী ন:

অনেক। তবে বেশির ভাগই জানি জাক- আরাগিসি, আরাগিত্থাং, সমাছামাল্লেতা (বশীকরন), বিভিন্ন ধরনের বাত বেদনা, প্যারালাইসিস, চর্মরোগ, একশিরা, ধাতু দুর্বল, মহিলাদের সুতিকা, বাচ্চা না হওয়া, মাথাঘোরা, বমি; ডাইরিয়া কলেরা, পেটের ব্যাথা, প্রসব বেদনা বা বাচ্চা হতে দেরি হলে, এসব ঔষধের জন্য আসে।

গা স মা:

কবিরাজি করতে হলে কি কোন যাদু মন্ত্র জানা থাকতেই হয়?

খা দী ন:

হ্যাঁ, কিছুটা তেলপড়া, পানি পড়ার মন্ত্র জানতে হয়। ঔষধি গাছ গাছড়া সংগ্রহের সময়েও কিছু মন্ত্র এবং নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়।

গা স মা:

আপনি একটা মন্ত্র বলবেন ?

খা দী ন:

এমনি এমনি কোন মন্ত্র বলা যায় না, উচিত না। এতে আমারই বিপদ হবে।

গা স মা:

যে কেউ কি কবিরাজি শিখতে এবং কবিরাজি করতে পারেন?

খা দী ন:

না, কবিরাজি শিখতে এবং কবিরাজি করতে হলে সাহস লাগে। ভীতুদের জন্য কবিরাজি না। কারন মিমাং মিদ্দি বল-সামরাং খাল্লাগিঙাবা। তখন ভয় না পেলে, চাকনা মাননোহা কবিরাজি করতে পারবে।

গা স মা:

সব শেষে একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?

খা দী ন:

হা হা হা…… অনুরোধটা কি আগে শুনি, তারপর বুঝবো…….

গা স মা:

আপনার মতো, আপনার বয়সী মান্দি সাংসারেক এখন খুব বেশি নাই বলা যায়। তাই আপনার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বিশ্বাস থেকে আমি/আমরা গারো/মান্দি সাংসারেক ধর্ম সম্পর্কে কিছু জেনে লিপিবদ্ধ করে রাখতে চাই।

খা দী ন:

আচ্ছা, সময় সুযোগ হলে বলবো। কারন আমাকে খামালের দায়িত্বে আর কবিরাজি করতে হয়। খুবই ব্যস্ত থাকি।

গা স মা:

আচ্ছা, যখন আসবো তখন আপনাকে জানিয়েই আসবো, ভালো থাকবেন, ধন্যবাদ।

খা দী ন:

তোমরাও ভালো থেকো, চু-মিখোহা চামান-রিংমানাংজাংজক…ধন্যবাদ

আরো পড়তে পারেন ধীরেন্দ্র সাংমার সাক্ষাৎকার

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য