রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ইতিহাস ও ঐতিহ্যআদি গারোদের শিশুর জন্মকালীন সংস্কার চু-জাঙ্গি প্রথা

আদি গারোদের শিশুর জন্মকালীন সংস্কার চু-জাঙ্গি প্রথা

গারোদের জীবনাচরনে চু-এর প্রভাব ব্যাপক। জন্ম-মৃত্যু-উৎসব যে কোন অনুষ্ঠানে চু গারোদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পানীয়। শিশুর জন্ম উপলক্ষ্যে এক প্রকার চু তৈরি করে থাকে যার নাম চু.জাঙ্গি। যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে খাবার-দাবারের পর চু পানের রীতি গারো সমাজের একটি প্রচলিত প্রচলন। সামাজিকভাবে স্বীকৃত বলে এটিকে তথাকথিত মদের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। আতপ বা বিন্নি ধানের চাল থেকে উৎকৃষ্ট চু তৈরি করা হয়। প্রথমে ভাত রান্না করে ঠান্ডা করে নেয়া হয়। তারপর সেই ভাতের সাথে বিভিন্ন প্রকার ভেষজ ওষধি দিয়ে তৈরি চুমান্থি মিশিয়ে রেখে দিতে হয়। একেক জনের তৈরি পদ্ধতি ও ওষধি একেক রকম। এর সাথে পবিত্রতার সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে এবং সচরাচর চু তৈরির প্রক্রিয়াটি থাকে গোপন।

গারোদের মদ বা চু সাধারণত তাদের বিভিন্ন সামাজিক আনুষ্ঠানে খাওয়া হয়। অনেক আগে থেকেই চাচ্চি/অথিতি আসলে চু দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো, এখনো হয়।

প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠির মতো গারোদের মধ্যেও শিশু জন্মকালীন কিছু সংস্কার এবং কুসংস্কার দুটোই রয়েছে। দম্পতির প্রথমজাত সন্তানের আগমন বার্তায় সকল পরিবারেই আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়। কিন্তু গারো পরিবারে শুধু প্রথম সন্তানের বেলায় নয়; বরং প্রতিটি সন্তানের আগমনেই পরিবার ও গোষ্ঠীর সকলের আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়। ফলে গর্ভবতী মা ও শিশুর যত্নের কোন ত্রুটি রাখা হয় না। অর্থাৎ গারো সমাজে ছেলে/মেয়ে কোন শিশুকেই কারোর বোঝা মনে করা হয় না। কারন গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারনে প্রতিটি মেয়ে বা মহিলা থাকেন মায়ের পরিবারে। আর সন্তানরা থাকে মায়ের পরিবারে বা মায়ের অধিকারে থাকার সুবাদে সকল গর্ভবতী মাকে সব ধরনের সহায়তা তার তার মা এবং বোনেরা দিতে পারেন। তাই মাতৃহীন বা পিতৃহীন অবস্থাতেও কোন শিশু অসহায় হয়ে পড়ে না। শিশুর মানক পক্ষ (নানী, মাসী, জ্যাঠি)-এর লোকজনেরা সেই শিশুর দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। গারো সমাজে, গারো ভাষায় এতীমখানা, ভিক্ষুক বা বৃদ্ধাশ্রম বলে কোন শব্দ নেই, তারা পরিচিত নয়।

এছাড়াও গারোদের প্রাচীন সংস্কারের পাশাপাশি কুসংস্কার ইত্যাদিতো আছেই। সে বিষয়ে আজ বলছি না। একটি বিষয় সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই আর সেটি হলো গারোদের গর্ভের সন্তানের নামে চু.জাঙ্গি প্রথা, যা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়।গারো চু-জাঙ্গি প্রথা

গর্ভবতী মায়ের প্রতি সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এর পরেও গর্ভবতী মা কোনভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে প্রথমে সেটা কবিরাজের ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা হয়। সন্তান প্রসবের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলে ঘরের সামনে বা কাছাকাছি ছোট্ট করে নকথুপ আলাদা খুঁড়েঘর তৈরী করা হয়। এই ঘরের পাশে সবসময় আগুন জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম আছে, যাতে কোন দেবতা বা শয়তানের আচড় থেকে নিরাপদ থাকা যায়। আদি গারোদের বিশ্বাস অনুসারে গর্ভবতী মায়ের অসুস্থ্যতা এবং গর্ভে সন্তান মারা যাওয়ার কারণ জা-রিদ্দিং এবং দারিচিক। জা-রিদ্দিং-এর মানে হচ্ছে, মনে করা হয়- দেবতাদের হাতে এক সন্তানের আত্মা আরেক মায়ের গর্ভে স্থানান্তরিত করার ক্ষমতা রয়েছে। এভাবে যদি কোন শিশুর আত্মা অন্য কোন গর্ভবতীর পেটে স্থানান্তর হয়ে থাকে, তাহলে সেই শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয় এবং অকালে মারা যায়। আবার কোন মায়ের শিশু গর্ভে থাকতেই যাতে মারা না যায়, হয় তাই গারোরা দারিচিক দেবতার পুজো দিতে হয়। জা-রিদ্দিং এবং দারিচিক আমুয়ার পদ্ধতি রয়েছে।

শিশুর জন্মের দিন দারিচিক পূজাই প্রচলিত। এই পূজার জন্যে একটি মোরগ এবং একটি ডিমের দরকার হয়। পুজোর সময় খামাল মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে মোরগের মাথা ছিঁড়ে এর রক্ত প্রসূতির সন্তান প্রসবের জন্য তৈরী করা নকথুপ-এর সামনে, দরজায় এবং গৃহিকর্তার মূল ঘরের দরজা এবং খুটিতে মেখে দেন। তারপর সন্তানের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য সেই উৎসর্গীকৃত মুরগীর পেট থেকে নাড়ি বের করে দো-রাসং দেখা হয়। এদিকে দাত্রিরা নবজাত শিশুর নাড়ি বাঁধার পর প্রথমে শিশুটিকে এবং প্রসূতিকে গরম পানি দিয়ে স্নান করান। তারপর মাকে পরিষ্কার কাপড় পড়িয়ে এবং শিশুকে সেদ্ধ করে শুকিয়ে রাখা কাপড়ে জড়িয়ে মায়ের কাছে দিয়ে দেন।

পূজা এবং আনুষাঙ্গিক কৃত্যাদি সমাপ্ত হলে নৈবেদ্যকৃত মোরগ কেটে হালকা লবন এবং মরিচ দিয়ে রান্না করা তরকারি দিয়ে নরম করে সেদ্ধ করা গরম ভাত প্রসূতি এবং সন্তানের পিতাকে খেতে দেওয়া হয়। জানা যায়, এই পুজোর বলিকৃত মোরগের তরকারি শুধুমাত্র সদ্যোজাত সন্তানের পিতামাতাই খেতে পারেন। তবে, ধাত্রী, খামাল এবং অন্যান্য সকলের জন্যেও অন্য মোরগ বা কোন মাংস রান্নার ব্যবস্থা থাকে। ভাত খাওয়ার আগে পর্যন্ত সকলে মিলে চু.জাঙ্গির চু আনন্দ সহকারে খেয়ে থাকে। এই চুজাঙ্গি খাওয়া হলে পরিবারের অন্যান্যরা এবং পাড়া প্রতিবেশীরাও এই সন্তানের জন্ম উপলক্ষ্যে তৈরী করা চু.নিয়ে আসেন। এই খানাপিনা সবার আনা চু শেষ না হওয়া পর্যন্ত আজিয়া-রেরে গেয়ে আমোদ ফুর্তির মাধ্যমে সারারাত চলতে থাকে।

অবশেষে প্রসূতি মাকে এই নকথুপ-এ এক সপ্তাহ থাকার পর সে ঘর ভেঙ্গে দিয়ে মা ও শিশুকে ঘরে তোলা হয়। এই ঘরে তোলার দিন ধাত্রীদের জন্য বিশেষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন থাকে।

আমার কাছে গারোদের এই চু.জাঙ্গি প্রথা এতো তাৎপর্যপূর্ণ কেন ?

সহজ কথায় চু.জাঙ্গি শব্দটি ব্যাখ্যা করলে এমন দাঁড়ায়, দেবতার কৃপালাভের উদ্দেশ্যে কিছু দেওয়ার সংকল্প, মাসনিক। অর্থাৎ গর্ভধারণের সংবাদটি পরিবারে লাভের পরপরই এই চু.জাঙ্গি প্রস্তুত রাখে। তারপর গর্ভের সন্তানটি সুস্থভাবে প্রসূত লাভের পর এই চু.জাঙ্গি পরিবেশনের মাধ্যমে ধন্যবাদানুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয় পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে। গারোদের এই চু.জাঙ্গি প্রথা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাচীন সংস্কার।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য