রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ব্লগসগারো আইনগারোদের বিবাহ বিচ্ছেদ | রান্দি মিক্‌চি গাল্লা (বিধবার অশ্রু বিসর্জন)

গারোদের বিবাহ বিচ্ছেদ | রান্দি মিক্‌চি গাল্লা (বিধবার অশ্রু বিসর্জন)

গারোদের বিবাহ বিচ্ছেদ এর রীতি নীতি অন্যান জাতি বা উপজাতিদের থেকে সম্পুর্ন্ন আলাদা । যার ফলে গারো সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়না বললেই চলে, এই আর্টিকেল আপনি এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চলেছেন ।

গারোদের সামাজিক সম্প্রীতির মনোভাব বা মূল্যবোধ অত্যন্ত উঁচুমানের। প্রচলিত রীতি অনুসারে, একজন ব্যক্তি একজনকে বিবাহ করার অর্থ শুধু স্বামীস্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন নয়; বরং তার গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং সে সম্পর্ক আজীবন বজায় রাখা।

তাই স্বামীর পক্ষের লোকজনের সাথে যিনি যতবেশি সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে পারবেন, ব্যক্তি হিসাবে তিনি অধিক গ্রহণীয়, সম্মানিত হবেন। তাই, কোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং স্বামী বা স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্বেচ্ছাকৃতভাবে কেউ বৈধব্য জীবনে আগ্রহ প্রকাশ করলে তার মানক (মাতৃ) পক্ষের সম্মতি নিতে হয়।

গারোদের বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পর্কে

সামাজিক মূল্যবোধের কারণে- বিচ্ছেদ বা বৈধব্যজীবনের জন্য কেউ চাইলেও (শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম না হলে) সম্মতি সহজে পাওয়া যায় না। কারণ, গারো সমাজে খ্রা-রাসং (মান মর্যাদা বা অমর্যাদা)-র বিষয়টি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া কারোর ব্যক্তিগত মনে করা হয় না, সেটা গোটা মাহারি বা গোষ্ঠির।

খ্রা-রাসং যেমন ব্যক্তির নয়, তেমনই গাম্মাসিয়া (জরিমানার) টাকাও ব্যক্তিকে দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় গোষ্ঠীকে বা মাহারিকে। তাই জরিমানার টাকার অংকের চেয়ে- দোষি সাব্যস্ত হয়ে জরিমানা প্রদানের কারণে মাহারি বা গোষ্ঠিগতভাবে হেয় হবার বিষয়টিকেও গারো সমাজ অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

দোষী সাব্যস্ত হওয়া যতটা লজ্জা, অপমানজনক, জরিমানা প্রদানকেও ততটাই অপমানজনক মনে করা হয়। অর্থাৎ একই ঘটনায় দুইবার লজ্জা পাওয়া বা ছোট হওয়া বলে ধরে নেওয়া হয়। তাই, পারতপক্ষে জরিমানা প্রদানপূর্বক দায়মুক্ত হওয়ার চেয়ে সহজ পন্থায় সম্প্রীতিতে আসার চেষ্টাই করে থাকে।

গারোরা মনে করে, কারোর বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়া এবং স্বেচ্ছায় বৈধব্য জীবনকে বেছে নেওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, স্বামী (বা স্ত্রী)-র গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক চ্ছেদ করা; যাকে গারো ভাষায় বলা হয় ‘আমাসারি ওয়াতগালা’। একারণে গারোসমাজে ‘জিক-সে গালগ্রিকা’ বা স্বামীস্ত্রীর ছাড়াছাড়ি বলার চেয়ে ‘আমা-সারি গাল্লা’ বলা হলে সেটি হয় চরম অপমানজনক।

যদি কেউ বৈধব্য জীবন যাপন করতে চায়

তারপরেও যদি কেউ বিচ্ছেদ বা বৈধব্য জীবন যাপন করতে চায়, তাহলে নিজের অপারগতা ও অযোগ্যতার দায় মাথায় নিয়ে, অপমান সয়ে স্বামীর গোষ্ঠীর কাছে গাম্মাসিয়ার (আর্থিক জরিমানা) মাধ্যমে মুক্তি পেতে হয়।

অথবা, গোষ্ঠীর বাইরের কাউকে বিয়ে করতে চাইলেও আগে শ্বশুরবাড়ীর গোষ্ঠীকে জরিমানা দিয়ে দায়মুক্ত হতে হয়। তারপরেও অদূর ভবিষ্যতে তার সন্তান বা গোষ্ঠীর কেউ শ্বশুরবাড়ির গোষ্ঠী বা মাহারীর কাউকে বিবাহ করতে চাইলে বা প্রস্তাব দিলে তখন হিনকামা-দকথেকা-জিস্থেকা (ভর্ৎসনা) সয়তে হয়।

গারো সমাজে লোক যেই মৃত্যুবরণ করুক, তার বিপত্নীক বা বিধবা পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারবেন, অর্থাৎ স্ত্রী বা স্বামী পাওয়ার অধিকার রাখেন- এটাই (প্রচলিত) রীতি। এই রীতিতে সদ্যবিধবা তার গোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মৃত স্বামীর জন্য শোক প্রকাশ করবেন, এটাকে বলা হয় রান্দি মিকচি গাল্লা। সেদিনই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এই বিধবাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তিনি স্বামীর পরিবর্তে স্বামী চান কিনা।

এর উত্তরে প্রার্থিনী যদি বলেন

আংসে-আপফানাগিত্তা- নকনি খ্রংনাগিত্তা,

আগান-খু.মংগ্রিকনা- দান্দানপা.এ দংনাগিত্তা,

দো.নি গিসিকোনা- ওয়াকনি জাগোকানা,

খ্রেংনাগিত্তা, অক্কাম চ্রিকনাগিত্তা,

আন্দালো রি.দিলনা, সেং.ও জা.দিলনা,

মানজা সাবজাওবা, বে.এনথাংনা হংজাওবা

আংনাবা- আরো নকথাং জামথাংনাবা

সাকসা মি.আ বিপাদে নাংনোআন

আঙাদে হাম্মিঙান…

আঙাদে আমা-সারিখোদে আমা-সারিইন মিংনো

না.সং গালনা-গুনা হাম্মুবা, আঙাদে গালজানো

হু,নান আমাসং-আপফাসং, আমানা-সারিনা

আঙাদে গ্রাপনা-গুগুনা, মিকচিথাংকো হাবুনা

না.সঙোনা রে.বামুং নাবামুং.। না.সং-

আমা না সারি না, খা.সানোমা মাদ্দুনোমা…

অর্থাৎ যদি পরিবারের জন্য আংসে-আপফা (স্বামী-পিতা বা কর্তা), নকনি খ্রং (ঘরের খুঁটি), জা.দিলনা (পথপ্রদর্শক)-এর প্রয়োজন আছে  বলা হয়। তাহলে স্বামীপক্ষের দৃষ্টিতে যদি মহিলাকে বয়সের দিক থেকে এবং দৈহিকভাবে সক্ষম (বা উপযুক্ত) মনে করা হয় এবং স্বভাব-চরিত্র, সংসারি মনোভাব সন্তোষজনক মনে হলে- তবেই তার জন্য দ্বিতীয় স্বামীর দেবার কথা ভাবা হয়।

তখন স্বামীর পরিবারে উপযুক্ত পাত্র না মিললে গোষ্ঠি বা মাহারিথেকে খোঁজা হয়; আর সেখানেও না মিললে অন্য মাহারিথেকে পাত্রের ব্যবস্থা করে দিতে হয়। স্বামীপক্ষের লোকজন পাত্রের ব্যবস্থা করে দিতে অপারগ হলে উক্ত বিধবার গোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার করেন এবং পরবর্তীতে স্বামীপক্ষ স্ত্রীপক্ষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন বলে মনে করা হয়।

অন্যদিকে কোন পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে এবং উক্ত পুরুষ/বিপত্নীক যদি বয়সের দিকথেকে এবং দৈহিকভাবে সক্ষম হন, তবে স্ত্রী পক্ষের লোকেরাই তার জন্য স্ত্রী দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন।

তবে, এক্ষেত্রেও উক্ত পুরুষ/বিপত্নীকের স্বভাব-চরিত্র, সংসারি মনোভাব মনমানসিকতা স্ত্রীপক্ষের লোকজনদের দৃষ্টিতে সন্তোষজনক হওয়া বাঞ্চনীয়। তা না হলে উক্ত পুরুষকে সংসারের মায়া ত্যাগ করে আমা-মানক (মা-বোন)-এর বাড়ি ফিরে আসতে হয়; যা একজন পুরুষের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য