সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ব্লগসগারোদের কৃষি জীবন বৈচিত্র এবং ব্যবহৃত আবাদি ফসল

গারোদের কৃষি জীবন বৈচিত্র এবং ব্যবহৃত আবাদি ফসল

এই আর্টিকেলে গারোদের কৃষি জীবন বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ।

আধুনিক বিশ্বায়নের ফলে সকল দেশের সকল জাতির জীবন প্রণালি এবং তাদের খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন এসেছে। গারোদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের সঙ্গে মাছ, মাংস, ডাল ও শাকসবজি তারা আহার করে। কথিত আছে, প্রাচীন ও মধ্যযুগে গারোদের জীবনপ্রণালী ছিলো একেবারেই আদিম এবং যাযাবর প্রকৃতির।

আর এই জাতির লোকেরা বেশিরভাগই পাহাড়, টিলা, গহীন অরণ্য, জলাশয়, স্রোতস্বিনী ঝর্ণা, বাঘ, হাতি, গন্ডার, বন্য কুকুর, হরিণ, মহিষ, খরগোস, সজারু ও অন্যান্য পশুপাখি অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাস করতো।

পরবর্তী সময়ে এরা কৃষিকাজ শেখে। পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করার কারনে বহুকাল আগে থেকে গারোরা জুম চাষে অভ্যস্থ ও দক্ষ হয়ে উঠেছিল। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, গারোদের আবাদকৃত অনেক ফসলের বাংলায় নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। যে যে ফসলের বাংলা নাম আমরা পাই নি; সেগুলো গারো ভাষাতেই দেওয়া হলো।

গারোদের কৃষি জীবন এবং আবাদি ফসল

) গারোদের ব্যবহৃত আবাদি ফসল 

জুমচাষে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গারোরা যে ফসলগুলো ফলাতো, সেগুলো নিম্নে সংক্ষেপে দেওয়া হলো-

  • মিমাসারাং (ধান): মিমাসারাং গিচ্চাক (লাল) এবং গুব্বক (সাদা) এ দুই জাতের ছিলো বলে জানা যায়। এই ধান খুবই কম সময়ে হয়ে যেতো বলে এ ধানের সাম সারাং। এ চালের ভাত অত্যন্ত সুস্বাদু।
  • মিকচ্চু গুব্বক (ধান): ধানের রঙ সাদা। তাই এধানের নাম মিকচ্চু গুব্বক। এই জাতের ধানের ফলন অনেক বেশি।
  • মিরিত্তি (ধান) : অনেকেই বলেন, এ ধানটিও মিকচ্চু প্রজাতির। তবে এ চাউলের আকার খুবই ছোট ছোট।
  • মিমিদ্দিম (ধান): দংমান এবং আল্লাং নামে দুই জাতের ভিন্নি ধান গারোরা আবাদ করতো।
  • চরেং (ধান): লাল বর্নের ধান; জানা যায় সুন্দর গন্ধের এ ধানটি অত্যন্ত সুস্বাদু  
  • মিসিরি (কাউন) : দাবু, জলসি এদুটি জাতের কাউন আবাদ করা হতো
  • খারেক (বরবটি) : রংবক, রুগুবা নামে দুই জাতের বরবটি গারোরা আবাদ করতো।
  • তিল (তিল): গিব্বক, গিসিম দুই জাতের।
  • রাউ (লাউ): গারোরা দুই জাতের (সাদা ও সবুজ রঙের) লাউ আবাদ করতো।
  • আকখারু: চালকুমড়াকে গারো ভাষায় বলা আকখারু। আকখারুর আবাদে ঝুমক্ষেতটাই সাদা হয়ে যেতো।
  • এলদি (হলুদ): দুই জাতের হলুদ গারোরা আবাদ করে থাকে।
  • ইচিং/হিচিং: আদা জাকসি, আদা জালওয়াক নামে দুই জাতের আদা আবাদ করতো বলে জানা যায়।
  • গমেন্দা (মিষ্টিকুমড়া): গমেন্দা_গুব্বক এবং গমেন্দা_গিচ্চাক এই দুই জাতের মিষ্টিকুমড়া আবাদ করতো বলে জানা যায়।
  • সুলসু (সরিষা): জানা যায়, গারোরা সরিষা তৈল হিসাবে ব্যবহারের চেয়ে বেটে ভর্তা খাওয়ার উদ্দেশেই এটি চাষ করতো।
  • বিল্লিক (এক প্রকার ডাল): গিব্বক, গিসি দুই জাতের।
  • মিখপ (ভুট্টা): গিসিম, গিব্বক, রিম্মত- এই তিন জাতের ভুট্টা আবাদ করা হতো।
  • মিগারু (জব): গিব্বক, গিসিম, মিদ্দিম ইত্যাদি তিন জাতের জব।
  • মেন্দু: গারোদের খাদ্যাভাবের সময়ে সিদ্ধ করে খাওয়ার জন্য মেন্দু (অড়হর) আবাদ করতো।
  • গ্রিদ/গ্রিখ  (আখ/ইক্ষু): ক্ষুধা নিবারণ এবং তৃষ্ণা মিটানোর আরেক উপায় ইক্ষু চাষ। চু বানানোর চুয়ানচির উপকরণ হিসাবে এর পাতা এবং চু-এর সাথে আখ ব্যবহারের কথা জানা যায়।
  • থিমাচু (লেবু): লেবুও কয়েক প্রকারের চাষ করতো।
  • বারিং (বেগুন): বারিং তিন জাতের। বারিংবুথি, বারিংখল (লম্বা সাইজ), থম্বা ইত্যাদি।
  • জা.লিক (মরিচ) : জালিক রংবক, গুব্বক, মিসিখি, ফাংপুল,
  • থি (বাঙ্গি): থিমান্দি, থিনারাং, থিগিসিম, থিখংচিত (আগরতলা)
  • খিল (তুলা): গারোরা দুই জাতের তুলা আবাদ করতো। তন্মধ্যে খিলমান্দি এবং খিলবক। খিলবক জাতের তুলার গাছ বড় হয় এবং এই গাছ দীর্ঘস্থায়ী।
  • মেন্দা : এইটি ঢেঁড়স গাছের পাতার মতো ছোট আকারের টকপাতা। এটিও দুই জাতের; গিব্বক মেন্দা, গিচ্চাক মেন্দা।
  • রাজাগুরু (টকপালং): টকপাতা হিসাবে খাওয়ার জন্য গারোরা এ রাজাগুরু আবাদ করে থাকে।
  • মি.চেং: টকপাতা ও মসলাহিসাবে ব্যব্যহৃত হয়।
  • ফানেত (তুলসি): ফানেত দুই প্রকার। সাদা এবং কালো। এর মধ্যে সাদা ফানেত গারোদের কাছে প্রিয় সবজির মধ্যে একটি।
  • ফং: একজাতের লাউ; যার আকার ছোট এবং বোটাথেকে সরু হয়ে শেষের অংশে ছোট গোল। এটি খাওয়া যায় না, তবে জলের পাত্র হিসাবে ব্যবহার করার জন্য আবাদ করা হতো
  • রাও/ফংরাও: এটিও লাউ গোত্রের; আকা কিছুটা বড়, তবে এটিও খাওয়া যায় না। তিতঘুটে এ ফলের অবয়ব বোটার দিকে কিছুটা ফোলা মাঝখানে সরু হয়ে শেষের অংশে বেশ বড়। এটি ছোট কলসি, জগ বা বদনার বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হতো।

) গারোদের আবাদি এবং অনাবাদী আলু

গারোদের খাবারের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য হলো আলু বা থা। থামান্দি হচ্ছে গারোদের চাষাকৃত মেটে-আলু; যা বড় বড় গাছের গোঁড়ায় লাগানো হয়। পরবর্তীতে এ আলুর লতাগুলোকে সে গাছের উপরে দিয়ে দেওয়া হয়। এ আলুগুলোর মধ্যে আবাদী এবং অনাবাদী (বনজ) রয়েছে এবং এর মধ্যেও কিছু কিছু জাত রয়েছে যেগুলোর ফল হয় এবং তা সেদ্ধ করে খাওয়া যায়।

খ.১) ভাতের বিকল্প হিসাবে নিম্নোক্ত ১৪ নং থেকে ৩১ নং আবাদি এবং অনাবাদী আলুগুলো গারোদের কাছে থা আলু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। নিম্নে আবাদি আলুগুলোর নাম দেওয়া হলো-

থা.মান্দি (গারো আলু), থা.মা (গারো কচু; পঞ্চমুখী নামে পরিচিত), থা.রিং মুকখি (মুখিকচু), থা.রিংদুধ/গুব্বক (দুধকচু), থা.বলচু (শিমুল বা শিমলাই আলু), থা.জং, থা.মিলাং গিচ্ছাক (মিষ্টি আলু), থা.মিলাং গুব্বক, থা.দিক, থা.থুরাক, থা.দাম্বু/থা.দাম্বং, হা.মাকগ্রেং, থা.মাচি (সাহেব আলু/মৌলভী আলু), থা.রিবু/থা.রেবু (জলপান আলু), থা.বুরত (গোল আলু) ইত্যাদি।

খ.২) অনাবাদি বা বন্যআলুগুলোও ভাতের বিকল্প হিসাবে সেদ্ধ করে খাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে-

স্থেং, আমফেং, থা.জা, থা.গিচ্চাক, থা.স্থেং, চংচঙ্গি ইত্যাদি

) গারোদের আবাদি অনাবাদি বা জংলি শাকসব্জি

গারোদের কাছে বনজঙ্গল মায়ের মতো। গারোরা ভাতের বিকল্প বনজঙ্গল থেকে শুধু আলুই পেয়ে থাকে, তা নয়। বরং বিভিন্ন পুষ্টি ও স্বাদের অনেক শাকসজিও পেয়ে থাকে। জঙ্গল থেকে যেগুলো শাকসবজি হিসাবে খাওয়া হয় তারমধ্যে-

খুমকা, কাকরোল, আপ্পলকা, আগাছিবিথি, আগেনদ্রাক, ফাসিম, বলব্রেত, সেরেংখি, মিসিনাছিল, বেংবংজাসি, সামগল্লক, গোবইরা শাক, কুইড়াকাটা, আদুরাক, খাক্কুবিজাক, সামগলদাক, চংমুরু, চঙ্গিবিরেত, স্থেংখাম্বি, সাম_জা.ল্লিক, দো.খুমি, আলত, জিংজত, সমুচ্চেং, দদমী_জা.ফা, দাকদিগদি, সামবিথি, দো.জংমা, বলনাগিল/বলনাচিল, দাম্বং ইত্যাদি ।

এছাড়াও বাংলাদেশের অঞ্চল ও আবহাওয়াভেদে উপযোগী সব শাকসবজি গারোরা চাষ করে নিজেদের প্রয়োজন মিটায়। 

) গারোদের ব্যবহৃত অনাবাদী বা জংলি ফল

জংলি শাকসবজির সাথে গারোরা অনেক ফলই খেয়ে থাকে। যেমন-

চিতপ্পা/চিচিতপ্পা, চাম্বুল, জয়না, থিক্রিং, দামন, আদুরাক, সামাদুরাক, দারিচিক, তিতিজাম, থেসেংকি মাকবুল (আনাইগোটা), বুতবুরি, টিরিক গালওয়াং, আম্ব্রি, আম্ব্রেথং/আম্বিলেথং, সুরিবিথি, গ.লং, মাক্কালেক্কিবিথি, মাক্কাফেল, সুসথুম, উমাকবিথি, সেংসু ইত্যাদি।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য