সোনারাম আর সাংমা। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় সোনারাম সাংমা গারোদের প্রথম জাতীয় নেতা; গারোদের প্রথম গারো রাজনীতিবিদ। আ.চিক আ.সং বা গারো ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি লড়াই-সংগ্রাম করেছিলেন।
গারো জনগণকে সচেতন করে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামিয়েছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন গারো হিলসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের না.চিরংদিক এর পাশে অবস্থিত রংরকগ্রি গ্রামে।
কিন্তু তার জন্মের সঠিক তারিখ ও সাল জানা যায় নি। তবে তার বিবাহ রেজিস্টার অনুসারে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন তার বয়স ছিল ২০ বছর। তাই ধারনা করা হয়, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম হয়েছিল।
সোনারাম আর সাংমা কর্মজীবন
তার যুবক সময়েই তারা বাবা-মা জন্মস্থান ছেড়ে গোয়ালপাড়া জেলার আমগুড়িতে চলে যায়। তার বাবা ক্লাং জি মোমিন ছিলেন প্রভাবশালী মানুষ এবং মা চামরে রংরকগ্রি সাংমা ছিলেন ধর্মানুরাগী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সোনারাম ছিল দ্বিতীয়। থকজে গাবিল মোমিনকে তিনি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিবাহ করেন। এই দম্পতির ছয়জন সন্তান ছিল।
সোনারাম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার ডাইরীতে লিখে রেখে গেছেন।
তার ডাইরীতে পাওয়া যায়-
"আমি, সোনারাম আর সাংমা, একটি স্বাধীন জাতির একজন সন্তান। আমি মহান যোদ্ধা সান্দ, রেরান ও চেগানের ভাগ্নে।” আরও পাওয়া যায়- ”একসময় আমার মা’র ছিল অনেক দাস-দাসী আর পরিচারক। বিশাল ধানের ক্ষেত এবং প্রচুর প্রজাও ছিল। লোকেরা আমার বাবা-মাকে ডাকত রাজা-রাণী বলে। কিন্তু এখন আমার বাবা-মা ও আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা গরীব।"
"রক্তের জন্য আপনি আমার আঙুল কেটে ফেলতে পারেন। প্রথমে সেই রক্ত দিয়ে কাগজে লিখবেন, আমার সমস্ত দাবি আজ গারোদের জন্য প্রদান করা হয়েছে। তাতে আমি খুবই খুশী হব। এরপর আমার জীবন নিয়ে আর কোন চাওয়া থাকবে না। আমাকে নিয়ে আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। পরে আমার মৃত দেহ নদীতে ভাসিয়ে দিন এবং এই দুধনই নদীর শেষ পর্যন্ত ভেসে যেতে দিন। আমার দেহ যতদূর পর্যন্ত ভেসে যাবে ততদূরই হবে গারোদের সীমানা।"
কী সাহসী কণ্ঠে বলেছিলেন সোনারাম আর সাংমা এই কথাগুলোতেই স্পষ্ট বুঝা যায়।
কার সামনে এবং কী অবস্থায় বলেছিলেন তা জানলে আরও ভাল করে ধারনা করা যায় সোনারাম কত সাহসী, নির্ভীক ও জাতি-নিবেদিত ছিলেন। পেছনে দিকে হাত বাধা অবস্থায় তাকে আসামের মূখ্য কমিশনার স্যার বামফিল্ড ফুলারের সামনে হাজির করানো হয়েছিল।
প্রচুর মানুষের সামনে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে বামফিল্ড তাকে বলেছিল, ”তুমি কেন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছ? তোমাকে এখন গুলি করে ফেলব।” এই কথার প্রতি উত্তরে নিসঙ্কোচে গারো নেতা সোনারাম ঐ কথাগুলো বলে। গারোদের ভূমির জন্য আন্দোলনের কারণে ব্রিটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয় সরকার।
সরকারী চাকুরীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় গারোদের উপর ব্রিটিশ সরকারের অমানবিক অত্যাচার-নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করেন। জমিদারদের অত্যাচার, আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা, জোরপূর্বক ভূমি থেকে উচ্ছেদ, সংখ্যালঘুতে পরিণত করে এদের অধিকার হরণ করার অপচেষ্টা প্রতিহত করেন। ঐসব অন্যায়ের প্রতিকার পাবার জন্য সরকারের কাছে বার বার আবেদন করেন।
কিন্তু তার আবেদন নিষ্ফল প্রমাণিত হলে তিনি সরকারী চাকুরী ছেড়ে দেন। চাকুরী ছাড়ার পর ছোট একটি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার কারণে তাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। একদিন কলকাতার ভ্রমণের সময় লখিপুরের রাস্তায় পড়ে থাকা একটি কাগজে তার চোখ পড়ে। ভাল করে পরীক্ষার পর বুঝতে পারেন, বিজনী জমিদাররা অনেক বছর ধরে যেসব ভূমি দখল করে আসছে সেসব গারোদের ভূমি। তখন থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এর বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।
যুগের পর যুগ শোষণ-বঞ্চনার কথা গারো লস্কর, নকমা ও স্থানীয় নেতৃবর্গের কাছে ব্যাখ্যা করে বুঝান। গারো জাতিত্ববোধকে শক্তিশালী করার জন্য সচেতন করে তোলেন গারো জনগণকে। একসময় পুরো গারো সমাজে সকলের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন।
তার নেতৃত্বে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালপাড়া জেলার দলগুমা নামক স্থানে বিশাল বড় এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেই সম্মেলনে গারোদের ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দফাসম্বলিত দাবিও উত্থাপিত হয়।
আন্দোলনের মূল দাবিগুলো ছিল নাজরানা ভূমি ও হাবরাঘাট পরগনা, গারোদের জন্য সংরক্ষিত বন ফিরিয়ে দেওয়া, বেগার সিস্টেম বন্ধ করা এবং গারো এলাকা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল সরকার ও বিজনী জমিদারদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার টাকা সংগ্রহের ব্যাপারটিও। দুই বছরের মধ্যে লস্কর ও নকমাদের সহায়তায় দুই লক্ষ রুপি সংগ্রহীত হয়। তখন থেকেই ব্রিটিশ সরকার গারো নেতাদের গ্রেফতার করা শুরু করে। তারপরও মামলা থেমে থাকেনি।
আন্দোলনের শেষ ও চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়ার আগেই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বাকরাপুর গ্রামে এই মহান গারো নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে গারো জাতির মধ্যে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। সোনারাম গারোদের স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন দেখতেন। ভারতে আজ যে গারো হিলস আছে, তা তার আন্দোলনেরই এক ফসল। তার অসামান্য অবদানের জন্য জাতি তাকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।