গারো সামাজিক প্রথা ও রীতি নীতি অন্যান্য জনগোষ্ঠীর দের থেকে একটু ভিন্ন । এই আর্টিকেলে গারো জাতির সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ।
সাধারণত প্রথা বলতে- কোন জাতিগোষ্ঠি বা সমাজের সামাজিক চাল-চলন, আচার-আচরণের নিয়ম কানুন; যা আইনের মতোন পালন এবং মান্য করা বুঝায়। ব্যাপক অর্থে প্রথা হল, কোন সমাজে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সেই সকল রীতিনীতি যা সংশ্লিষ্ট আইনের কর্তৃত্ব বা আইনের মতো ক্ষমতাসম্পন্ন বিধি ব্যবস্থাকে বুঝায়।
রীতিনীতি বা প্রথা হতে হলে অবশ্যই সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হবে, দীর্ঘকালব্যাপি তা প্রচলন থাকতে এবং সমাজের লোকজন এটিকে আইনের মতো বাধ্যকর হিসেবে মান্য করবে।
গারো সামাজিক প্রথা ও রীতি নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত
গারোদের সামাজিক প্রথা আলোচনার পূর্বে বলে রাখা ভালো, গারোদের সামাজিক প্রথাসমূহ এখনো যথাযত বলবৎ থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আলোচনা করা যাক গারোদের প্রাচীন রীতি পদ্ধতি নিয়ে; গারোদের সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হয় মাতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিতে; এটাই প্রচলিত বাক্য।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রীতি-নীতিনুসারে গারো পুরুষেরা বিয়ের পর তাঁদের স্ত্রীর পরিবারে থাকেন। গারো পুরুষেরা সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। মায়ের পদবি ও পরিচিতিতেই সন্তানরা পরিচিত হয়। গারো সমাজ বা পরিবার নারী দ্বারা শাসিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়; মা বা নারীকেই পরিবারের প্রধান বা চালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
গারো পরিবারে পুরুষের ভূমিকা নেই তা নয়; থাকলেও তা খুবই সীমিত ইত্যাদি আলোচনা, সমালোচনা এবং বিভিন্ন গ্রন্থ লেখালেখি হয়ে আসছে।
কিন্তু আধুনিককালে অনেকেই বিশেষ করে পুরুষেরা এমন ধারনাকে মানতে নারাজ। তাঁদের (পুরুষদের) যুক্তি হলো, বাস্তবতা ভিন্ন। শুধুমাত্র মেয়েদের সম্পত্তির মালিকানা এবং সন্তানদের মায়ের পদবি কারনেই গারো সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলা যায় না, বা মা বা নারীকেই পরিবারের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
সম্পত্তির প্রকৃত মালিক
প্রচলিত গারো রীতি অনুসারে সম্পত্তির মালিক যেমন কোন পুরুষ হতে পারে না; ঠিক তেমনই সম্পত্তির প্রকৃত মালিক একক কোন নারীও নয়। বরং বলা যায় সমূহ সম্পত্তির মালিক গোষ্ঠী বা চাচ্চি।
কারণ, কোন জমির মালিক কোন মেয়ের হলেও বিশেষ করে চ্রা-দেফান্তেদের (পুরুষের) অনুমতি বা সমর্থন ব্যতীত সেই সম্পত্তি কাউকে ভাগবাটোয়ারা বা হস্তান্তর এবং ক্রয়-বিক্রয় করতে পারেন না। পরিবারের ভাই, মামা, আচ্চু, ভাগ্নে অর্থাৎ চ্রাদের নিয়ে মানকপক্ষের (মা, বোন, নানী, মাসী, জ্যাঠি, ভাগ্নি এবং তাদের স্বামী অর্থাৎ পুরুষসহ) সকলে মিলেই তা হস্তান্তর বা বিক্রয় করতে পারেন।
যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠান বা আইন সংক্রান্ত বিচার সালিশ ইত্যাদিতে পুরুষরাই মূল আসনে বসেন। সভাপতিত্বকারী, আলাপ আলোচনাকারী এবং সিদ্ধান্ত পুরুষেরাই করে থাকেন। সেখানে মহিলারা সবসময়ই সেই আলোচনার শ্রোতামাত্র।
বরাবরই, পুরুষদের অনুমতি ছাড়া এককোনায় বসে থাকা মহিলারা কখনোই কথা বলার সুযোগ পান না। কোন বিচার-সালিশ-মিমাংসার কারণজনিত আলোচনায় কেবল বাদী-বিবাদী অথবা স্বাক্ষ গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদেরকে কথা বলতে দেওয়া হয়।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, মাতৃতান্ত্রিক কিভাবে বলা যায়?
শুধুমাত্র মেয়েদের সম্পত্তির মালিকানা এবং সন্তানদের মায়ের পদবি কারনেই গারো সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলা কতটুকু যৌক্তিক?
গারোদের সামাজিক প্রথাসমূহ
গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক নাকি মাতৃসূত্রীয় এমন ধারণার পক্ষে-বিপক্ষে বা সত্যতা যাচাই করতে হলে গারোদের সামাজিক শিষ্টাচারসমূহ এবং গারোদের সামাজিক প্রথাসমূহ আলোচনাগুলো কিঞ্চিৎ সুরাহা করবে বলেই বিশ্বাস করি।
পরিবার এবং সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে গারোরা সামাজিক শিষ্টাচারসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মেনে চলে। তারপরও উল্লেখযোগ্য কিছু প্রথা রয়েছে।
তন্মধ্যে
- (ক) খিম/হাখিম প্রথা
- (খ) নকনা-নক্রম প্রথা
- (গ) মাহারি-মাচং প্রথা
- (ঘ) আগাত্তে/আগাথে-চাওয়ারি প্রথা
- (ঙ) চ্রা প্রথা
- (চ) মানক প্রথা
- (ছ) জিকচল প্রথা ইত্যাদি।
গারোদের সামাজিক প্রথাগুলো অলিখিত; কিন্তু এই গারো সমাজের বিধি-ব্যাবস্থাগুলো এখানো তাদের সমাজ ব্যবস্থায় স্থিতিশীল রাষ্ট্রীয় আইনের মতোই মান্য করে। গারো সামাজিক প্রথাসমূহ-
(ক) খিম বা হাখিম প্রথা :
দুটি ভিন্ন মাচং যেমন মৃ মাহারির ছেলের সাথে নকরেক মেয়ের বিবাহের সূত্রে উক্ত উভয় মাচং বা মাহারির মধ্যে যে সম্পর্ক বা আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। এবং এই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার যে দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যাবলি উক্ত মাচং/মাহারীদের উপর বর্তায়।
এটাকেই গারো সমাজে খিম প্রথা বা হাখিম প্রথা বলা হয়। অর্থাৎ মৃ এবং নকরেক- এ দুই পক্ষের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরী হয়, সেটিই খিম বা হাখিম। গারো সমাজ এই খিম বা হাখিম খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে এটিকে যুগযুগ ধরে টিকিয়ে রাখে।
আবার কোন কারণে উক্ত ছেলেমেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটার সাথে সাথে এই হাখিম ভেঙ্গে যায়, যা এটাকে উভয় পক্ষের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। আবার স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুজনিত কারণে এবং উক্ত বিধবাকে সেগিদ্দি (দ্বিতীয় স্বামী) বা বিপত্নীককে জিকগিদ্দি (দ্বিতীয় স্ত্রী) প্রদানের অস্বীকৃতি জানালে সে ক্ষেত্রেও হাখিম খুমসত্তার মাধ্যমে উভয় পক্ষের সম্পর্কের ছিন্ন ঘটে থাকে।
গারো সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বলা হলেও এই খুম তৈরী বা খুমসত্তার কাজে মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকা গৌণ। তাই পুরুষদেরকেই শুরু এবং শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। খুম বা হাখিম তৈরীর সময় কমপক্ষে ৩/৪ বার ছেলে বা মেয়ের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হয়। সিংফাত্তা (প্রথম ও দ্বিতীয়বার বউ/জামাই প্রস্তাবে)-র সময় শুধুমাত্র পুরুষ (চ্রা, আপফা-গুমি)-রাই প্রস্তাব নিয়ে যান।
এভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই সম্পর্ক তৈরীর কাজে পুরুষের থাকতে হয় এবং শেষমেশ সিংচত্তা (গড়বর), বা মে.চিক/মা.নক রা.এ রে.আ-র সময় এবং বাগদান(বউ/জামাই উঠানো) বা পানচিনির সময় মহিলাদের নিয়ে যাওয়া হয়।
এই খুমসত্তার বেলাতেও উভয়পক্ষের সম্মানিত বড় বড় চ্রা-দেফান্তে (পুরুষ)দের নিয়ে বৈঠকে বসেন। প্রথমে দুপক্ষের যৌক্তিক আলাপ আলোচনা বা দাবি-দাওয়া শুরু করেন, তারপর মহিলারাও সেখানে যোগ দিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে নিজেদের যুক্তি, অভিযোগ, অনুযোগ প্রকাশ ধরেন (কিংবা প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডাও হয়ে থাকে), তারপর চুড়ান্ত দরবারের মাধ্যমে জরিমানা ধার্য এবং পরিশোধের পর উক্ত স্বামী-স্ত্রী ও দুই পরিবার, মাচং/মাহারীর বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়, তাকে খিমসত্তা বা হাখিম খুমসত্তা বলা হয়।
(খ) নকনা-নক্রম প্রথা :
অন্যান্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার তুলনায় গারো সমাজে নারীর স্থান অনেক উর্ধে। এই সমাজ তাদের পারিবারিক, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অপরিসীম আত্মসম্মানের নিশ্চয়তার বিধান রয়েছে। আমি আগেই বলেছি, গারো পুরুষেরা বিয়ের পর তাঁদের স্ত্রীর পরিবারে বা শ্বশুর বাড়িতে থাকে।
সমাজ ব্যবস্থার কারণেই গারো পরিবারে নকনা নির্বাচন করতে হয়। সাধারণত ছোট মেয়েকে অথবা একমাত্র মেয়ে হলে তাকেই নকনা হিসাবে মনোনীত করা হয়ে থাকে। আর পরিবারের চ্রা-দেফান্থেদের পরামর্শ ছাড়া এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি কখনও গ্রহণ করা হয় না।
এই নকনা এবং নক্রমের দায়িত্ব পরিবারের কর্তৃত্ব করা। তাই, পরিবারের কর্তা কর্তৃ বা মা-বাবার ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য চ্রাগণই এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞে সবসময় এগিয়ে আসেন। নকনার মেয়েটির স্বামীই নক্রম (ঘরের খুঁটি) হিসাবে পরিচিত হন। নক্রম পদটি গারো সমাজে একটি মর্যাদাপূর্ণ পদ; যার বিশেষ সম্মান এবং পরিবার এবং গোষ্ঠীর দায়িত্ব রয়েছে।
এক্ষেত্রে ছেলেটি শ্বশুরের আপন ভাগ্নে হয়ে থাকলে, সে জামাতাই নক্রম হওয়ার যোগ্য রাখেন বা দাবী করতে পারেন। পরিবারের মেয়ে সকলকে পরিবার থেকে সম্পত্তির ভাগ দেওয়ার পর এই নকনাই শ্বশুর-শাশুড়ির সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা লাভ করেন।
ফলে এই নক্রমই শ্বশুরের সকল ধরণের পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন শুরু করেন। শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর পিতামাতা বা স্বশুর-শাশুড়ির আসনটিই নকনা এবং নক্রমের জন্য দেওয়া হয়। এভাবে সবার ছোট জামাতা হয়েও পরিবারের সমূহ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তার শ্বশুর বা পিতার সমতূল্য তামাম সমাজে সম্মান প্রাপ্ত হন।
এবং এই নক্রম পরিবারের সকলকে পিতার মতো সকলকে আগলিয়ে রাখেন, সবার বিপদ-আপদে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। তাই এটাকে অত্যন্ত গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখা হয় বলে পরিবারের বর্তমান কত্রী বা মা, মানক ও চ্রা ব্যাতীত একেবারেই অনুচিত মনে করা হয়।
আবার সবার ছোট মেয়ে যদি তার বাবার মাচং ব্যাতীত অন্য কোন মাহারিকে বিয়ে করে, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ যদি বোনদের কেউ তাদের পিতার মাচং অথবা আপন বা কাছের ভাগ্নেকে বিয়ে করে; সেক্ষেত্রে সেই হওয়ার জন্য দাবী করতে পারে। তবে, অবশ্যই বাবা, মা/শ্বশুর-শাশুড়ির পছন্দের জামাই হতে হবে। শ্বশুরের স্থান বলে কথা। অলস, উদাসীন, অপব্যায়ি হলে হবে না।
পরিবারের লোকদের প্রতি মায়া-মমতা, বুদ্ধিমত্তা, বিচিক্ষণতা দেখানোর মত (সংসার/পরিবার টিকিয়ে রাখার মত যোগ্যতা/ক্ষমতা) গুণ থাকাটাকেও নক্রম হওয়ার যোগ্যতা হিসাবে বিবেচিত হয়।
অন্যদিকে উক্ত নক্রম নকনা পরিবার পরিচালনায় ব্যর্থ হলে, নিজে থেকে অস্বীকৃতি জানালে তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী আগাথে মেয়েদের মতো আলাদা ঘর করে সংসার করতে পারবেন, তবে নকনা হিসাবে প্রাপ্ত ধনসম্পদ হতে বঞ্চিত হবেন আবার কোন কারণে নকনা-নক্রমের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে- অটোমেটিক্যালি পুরুষটি তার নক্রমের পদটি হারাবেন। অথবা নকনা মেয়েটি পরকীয়া সংক্রান্ত বা স্বেচ্ছাকৃতভাবে ঐ পরিবার থেকে চলে যাওয়ার কারণে উভয়ই তাদের নকনা-নক্রম পদ হারাবেন এবং তাদের প্রাপ্ত সকল সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবেন। এভাবে গারো সমাজ যুগে যুগে চলে এসেছে।
(গ) মাচং (মাহারি) প্রথা :
সাংমা বা মারাক হচ্ছে মাহারি (গোত্র); আর এ (সাংমা বা মারাক) মাহারিদের অধীনে থাকে মাচং/চাচ্চি বা উপগোত্রসমূহ; যেমন- ম্রং, নকরেক, মৃ, সিমসাং, দফো, রিছিল, চিরান ইত্যাদি। দফো চাচ্চিরা সর্বাগ্রে শুধু দফোদের বিষয়ে বা স্বার্থ চিন্তা করবেন, গুরুত্ব দিবেন-এটাই স্বাভাবিক।
অন্যান্য মাগুব্বুনগুলোও/গোত্রধারীরা একই ভাবে নিজ নিজ মাচং বা গোষ্ঠীর জন্য কাজ করেন। ধরুন, যদি সকলেই নিজ নিজ মাচং বা গোষ্ঠীর স্বার্থ চিন্তা করেন, তারপর ক্ষেত্র বিশেষে যদি প্রয়োজন পড়ে তখন (সাংমা বা মারাক) মাহারির জন্য কাজ করেন।
বাস্তবতায় আমরা যা দেখি, তাহলো গুরুত্ব দিচ্ছি বা কাজ করছি দফো মাচং (নিজ গোষ্ঠীর)-এর জন্য, অথচ নাম ফুটছে বৃহৎ সাংমা-মারাকের। এ কারণে প্রচলিত মাহারি প্রথাকে মাহারিপ্রথা না বলে মাচংপ্রথা বলাই অধিক যৌক্তিক মনে হয়। কারণ, আমরা বেশ কয়েকজন প্রবীন ব্যক্তিদের সাথে বিষয়টি সম্পর্কে আলাপ করেছি।
অনেকে বলেন, স্কাংদে মাচং আর মাহারিখো একিন (Same) ইন্নারিনমুং, হিনানা মাহারিপ্রথা ইন্নাবা। আবার অনেকেই বলেছেন, বিবিগিত্তা ইন্না রেআঙোদে মাচংপ্রথা’-আন হঙাদে হংনমুংখন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। গারো প্রবীনদের যুক্তি মোতাবেক এই সামাজিক ব্যাবস্থাকে মাহারিপ্রথা না বলে মাচংপ্রথা বলাই শ্রেয়।
নিজ নিজ মাহারি বা মাচং-দের মধ্যে সুশৃঙ্খলভাবে পরিবার ও সমাজ জীবন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হয় এ প্রথার মাধ্যমে। পূর্ব পরিচয়হীণ কোন ম্রং পৃথিবীর আরেক প্রান্তে গিয়ে কোন ম্রং মাচংকে পেলেও তারা আপন ভাই অথবা বোনের মত (অথবা বয়োজ্যাষ্ঠ হলে মামা, আম্বি, আচ্চু, আজং, মাসি ইত্যাদি ) হয়ে যাবেন, এটাই মাচং প্রথা।
বলা যায়, এটি গারো জাতির মূল্যবোধ, যা সকলেই এটিকে দ্বিধাহীন এবং বাধ্যগতভাবে মেনে আসছে যুগের পর যুগ। এই প্রথার বিশেষত্ব হচ্ছে, মৃ এবং সিমসাং সাংমা গোত্রের হলেও কোন মৃর বিচার-আচার, সহায় সম্পত্তি সিমসাং-এর কাছে যাবে না বা হস্তান্তর হবে না।
অন্যদিকে, মাহারি বা মাচং প্রথার সূত্র ধরে কোন পরিবারের কর্তার বা শ্বশুরের মাচং (বা আপন বা গোষ্ঠীর ভাগ্নে হলে) ধারি জামাতা হলে, বিশেষ ক্ষেত্রে সে নক্রম পদের জন্য দাবী করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে উক্ত শ্বশুর যদি উপযুক্ত কারণ ছাড়া অন্য মাহারি/মাচং-এর জামাতাকে নক্রম মনোনীত করতে চাইলে নিজ মাচং/মানকের সাথে তুমুল বাকবিতণ্ডা বাঁধতে দেখা যায়।
অনেক সময় সাল্লেগা (ছেলে/জামাইকে ফেরত নেওয়ার) উপক্রম হয়। কেননা, শ্বশুর নিজের চাচ্চিকে/ভাগ্নেকে নক্রম করতে আপত্তি করলে তার (জামাই/ভাগ্নে ও শ্বশুরের-এর) মাহারি/মা.নকেরা মাহারিগতভাবে যে অধিকার থাকে, সে অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং নিজ মাহারিকে অবমাননার সামিল মনে করা হয়। শুধু তাই না, মাহারিগতভাবে এই চরম অবমাননা, অপমানবোধ করার কারণে মাচং/মানকের সাথে তুমুল বাকবিতণ্ডা বেঁধে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
গোষ্ঠীর ভেতরে কেউ অন্যায়, দুর্নীতি করতে দেখলে নিজ মাচংদের মধ্যেই শাসন বা সমাধান করা হয়। কোন কারণে অন্য মাচং বা মাহারিদের সাথে দ্বন্দ্ব এমন কি বিচার সালিসের প্রয়োজন হলে সেখানে নিজ গোষ্ঠীর সকলেই যার যার মাচং-এর পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন।
বিচারে কেউ বিজয়ী বা দোষী সাব্যস্ত হলে গোষ্ঠীর সকলেই এর ভাগীদার হবেন। এমনকি, বিচারে জরিমানা প্রদানের ক্ষেত্রেও গোষ্ঠীর সকলে মিলে উক্ত জরিমানা পরিশোধ করা হয়। মাহারি বা মাচং-এর মধ্যে যিনি বয়োজ্যাষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ, তিনিই ঐ মাচং-এর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন।
উক্ত সবসময়ই তার মাচং গোষ্ঠীর মধ্যে একতা, উন্নতি ও সম্প্রীতির জন্যে উদারভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই মাহারি বা মাচং প্রতিনিধিগণ অন্যান্য গোষ্ঠীর কাছে গেলেও নিজগোষ্ঠীর পক্ষে সবসময়ই বিশেষভাবে সম্মানিত হয়ে থাকেন।
(ঘ) আগাত্তে/আগাথে_চাওয়ারি প্রথা :
গারোদের কোন পরিবারে নকনা ব্যতীত সকল মেয়েই আগাত্তে বা আগাথে; আর তাদের স্বামী সকলকেই চাওয়ারি। এই আগাথে মেয়েরাই ঐ পরিবারের জামাতাদের কাছে নিকটতম জিকচলগ্রি। নকনা ব্যতীত উক্ত আগাথে মেয়েরা সকলেই সমহারে পিতামাতার কাছ থেকে সম্পত্তির ভাগ পেয়ে থাকে।
এ আগাথে মেয়েরা বিবাহের পর সাময়িকভাবে স্বামী সন্তান নিয়ে পিতার বাড়িতে বসবাস করেন। পরবর্তীতে তারা আলাদাভাবে শ্বশুরের দেওয়া জমিতে বা নিজেদের পছন্দমত অন্য জায়গায় ঘর তুলে নিজেদের মতো করে সংসার শুরু করতে পারে। এই মেয়েরা এবং স্বামীরা শ্বশুর বাড়িতে (একান্নবর্তী) থাকাকালীন অথবা আলাদা সংসার করলেও সকলেই একই পরিবারের মত সম্পর্ক বজায় রাখবেন এবং একে অপরের ভালোমন্দে সমানভাবে অংশগ্রহণ ও অবদান রাখবেন।
এমনকি, তাদের সকলের ছেলে-মেয়ে সকলেই নিজের ছেলে-মেয়ের মতোই নিয়ন্ত্রণ, শাসন করার ও সমাদর পাওয়ার অধিকার রাখে। এহেন বলে রাখা ভালো, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সংসারের দেখভালের অধিকার যেমন একজন স্বামীকে দেয়া হয়, তেমনি তাকে স্ত্রী শাসনের অধিকারও দেয়া হয়ে থাকে।
এই আইন অথবা পারিবারিক ও সামাজিক নিয়মানুযায়ী স্ত্রী তার স্বামীকে শাসন করার মতো কোনো অধিকার খাটাতে পারে না। সমাজ ব্যবস্থা স্বামীকে স্ত্রীশাসনের অধিকার দিয়েছে, কিন্তু স্ত্রীকে স্বামী শাসনের কোনো অধিকার দেয়া হয়নি। ফলে, খুব কম সংখ্যক নারীই এ ব্যবস্থায় পুরুষ দ্বারা নির্যাতিত হয়ে থাকে। আর এসব পরস্পরকে দেখভাল করা, সহযোগিতা করা, সতর্কতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সকল আগাথে এবং চাওয়ারিদের সকলের।
(ঙ) চ্রা প্রথা :
দফো মাচং পরিবারের পুরুষ সন্তান সকলেই উক্ত পরিবার বা গোষ্ঠীর চ্রা। অর্থাৎ নিজ পরিবার বা গোষ্ঠীর সকল পুত্র, ভাই, মামা, ভাগ্নে, এরাই চ্রা। ঠিক অন্য মাহারী বা গোষ্ঠির ক্ষেত্রে সমান এবং একইভাবে প্রযোজ্য হবে।
গারো সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলা হলেও সংসারের দেখভালের অধিকার যেমন পুরুষের থাকে, তেমনি তার মানক- অর্থাৎ তার স্ত্রী, মা, বোন, ভাগ্নিদের শাসনের অধিকারও থাকে। কোথাও অশান্তি বা বিরোধ থাকলে বা এর সমাধান না হলেই ঐ চ্রাদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়, বিসংনি চ্রা-দেফান্থে দংজাহানি অর্থাৎ তাদের কি মধ্যে কি চ্রা নাই। শ্বশুর বাড়িতে জামাইয়ের প্রধান সহায়ক স্ত্রীর চ্রাগণ।
সোজা কথায় এই চ্রাদেরকে গোষ্ঠী বা মাহারি/মাচং-এর রক্ষক। কোন বিচার সালিশে বসে আলাপ আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহনের অধিকার এই চ্রাদের। তাদের সিদ্ধান্তকেই মানকেরা মেনে নিতে বাধ্য। গারো সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলা হলেও নিজ গোষ্ঠী এবং পরিবারের তার মা, বোন, ভাগ্নিদের পরিবারে ভালো-মন্দের দায় সেই চ্রাদের উপরই বর্তায়। গারো পুরুষেরা সম্পত্তির মালিকানা হতে পারেন না।
কিন্তু এটুকু ছাড়া গারো সমাজের সকল আইন, রীতিনীতির কারিগর এই পুরুষেরাই। এই চ্রাদের সিদ্ধান্ত বা অনুমতি ছাড়া কোন পরিবারিক বা সামাজিক কর্মসাধন একেবারেই অসম্ভব। আমা-মানকপক্ষে পরিবার ও গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য, ন্যায্যতা, শৃঙ্খলা এবং সকল ভালোমন্দ দেখার এবং আইন, রীতিনীতি বিষয়ে গবেষণা ও পরিচালনার দায় দায়িত্ব পুরুষ অর্থাৎ এই চ্রাদের হাতে।
তাই পারিবারিক এবং গোষ্ঠিগত যে কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এই চ্রাদের শরণাপন্ন হতে হয়। তাই, গারোদের যে পরিবারে বা গোষ্ঠীর পক্ষে চ্রা নাই, সে পরিবার বা গোষ্ঠীকে বলা হয় এতিমের মত। তবে, গারো সমাজে এই চ্রাদের এরূপ ক্ষমতা থাকলেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নারীদের মতো পুরুষ দ্বারা গারো নারীরা নির্যাতিত হয় না।
অতএব, এ চ্রাগণ সব সময়ই তার মাচং গোষ্ঠীর মধ্যে একতা, উন্নতি ও সম্প্রীতির জন্যে উদারভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই ব্যাক্তি অন্যান্য গোষ্ঠীর কাছে গেলেও নিজগোষ্ঠীর পক্ষে সবখানেই বিশেষভাবে সম্মানিত হয়ে থাকেন।
(চ) মা.নক প্রথা :
গারো সমাজে নারীর স্থান অত্যন্ত সম্মানজনক। এ সমাজের রীতি অনুযায়ী নারীকে পূর্ণমর্যাদা দেয়া হয়। যে কোন সমাজেই পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে নারীর দায়িত্ব ও গুরুত্ব অপরিসীম। তেমনই গারো সমাজেও মায়ের প্রাধান্য উল্লেখযোগ্য।
শাব্দিক অর্থে মা.নক মানে মায়ের ঘর। চিরান মেয়ে বা নারী যেকোন চিরান লোকের মা.নক; অর্থাৎ মায়ের মত। এ অর্থে বোন, ভাগ্নীরাও মায়ের সমতুল্য। মায়ের অবর্তমানে নারীরা যে কোন চিরান লোককে সেবা, ভরণ-পোষণ, আদর আপ্যায়ন এবং যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে বাধ্য।
কোন অবিবাহিত (বা বিপত্নীক) পুরুষের অর্জিত যে কোন স্থাবর অস্থাবর সম্পদের দেখাশুনা করতে বাধ্য। এই মা.নকেরা তাদের চ্রাদের আদর আপ্যায়নের দায়িত্ব নিতে বাধ্য, তাদের শাসনও করতে পারে। এই মা.নকেরা ভরণ-পোষণে যেমন বাধ্য, তেমনি কোন চ্রা দোষ করলে, তার বিচার সালিশ হলে সেই চ্রাদের পক্ষ নিতে বাধ্য।
শুধু তাই নয়, চ্রাদের পক্ষে যেকোন বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডি বা জরিমানা দিতে হলে তা মা.নকেরাই পরিশোধ করে থাকেন। গারো পরিবারে মা-ই পরিবারের সমস্ত সম্পত্তির মালিক বলে নিজ পরিবার এবং গোষ্ঠীর সবাইকে মাতৃরূপ সেবা, ভরণ-পোষণ, আদর আপ্যায়নের দায়-দায়িত্ব নারীকেই বহন করতে হয়।
এমনকি চ্রাগণ কোন কারণে আশ্রয় গ্রহণ করতে চাইলে এই মা.নকেরা আশ্রয় এবং নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। আবার বিচার-আচারে মা.নকের ভালোর দিকটা দেখাও চ্রাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
(ছ) জিকচল প্রথা :
শাব্দিক অর্থে জিক হচ্ছে স্ত্রী। স্ত্রীর পরিবারের যেমন- স্ত্রীর ভাই, মামা এবং মাসি, জ্যাঠি, বোন এবং তাদের স্বামীদের সম্মিলিত গোষ্ঠীকে জিকচল বলা হয়। জিকচলগ্রির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, একজন পুরুষ বিবাহের পর স্ত্রীর বাড়িতে থাকে। তখন এই সময়ে নতুন জামাইকে তাদের পরিবেশে মানিয়ে নিতে বা চলতে সহযোগিতা করে থাকেন। জামাইয়ের সুখ স্বাচ্ছন্দ, সুবিধা অসুবিধার দিকে সস্নেহে নজর রাখেন। স্ত্রীর সাথে বনাবনি হচ্ছে কিনা, কিংবা কিভাবে নতুন সংসার যাপনে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
স্ত্রী কিংবা পরিবারের অসুস্থ্যকালীন বা কোন প্রকার বিপদ আপদে প্রথমে এই জিকচলগ্রিই প্রথমে এগিয়ে আসেন। স্ত্রী মারা গেলে ঐ স্ত্রীর পরিবর্তে জিকগিদ্দি (দ্বিতীয় স্ত্রী) এবং প্রথম স্ত্রী শারীরিক অথবা মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে অথবা কোন উল্লেখযোগ্য কারণে স্থায়ীভাবে সংসারকর্মে অক্ষম হলে সেক্ষেত্রেও অনচাপ্পা, জিকগিদ্দি প্রদানের ব্যাপারে এই জিকচলগ্রিরা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন।
কোন স্ত্রী যদি স্বামীর সাথে স্ত্রী বা নারীসুলভ আচরণ না করে সেক্ষেত্রেও চিজকচলগ্রির কাছে উক্ত স্বামী সমাধানের জন্য নালিশ করতে পারে। সেক্ষেত্রেও জিকচলগ্রিরা এর সমাধান দিতে, করতে বাধ্য। অন্যদিকে বিবাহিত কোন সংসারকর্ম ঠিকমত পালন না করলে, স্ত্রী-সন্তানদের সাথে বারবার বিনাকারনে বা অগ্রহণযোগ্য কারণেও দুর্ব্যবহার করলে, জিকচলগ্রির যৌক্তিক পরামর্শ অবহেলা করলে, সমাজে নিন্দনীয় কাজ বা অপরাধ করলে ঐ জিকচলগ্রিও ছেলের মানকের কাছে সমাধানের জন্য নালিশ করতে পারে।
একারণেই গারো পুরুষকে দুই দিকেই সন্তুষ্ট করে তার স্বীয় গুণাবলী ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সংসারধর্ম পালন করে চলতে হয়।
অন্যদিকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোনো গারো পুরুষেরই সম্পত্তির মালিক হওয়ার রেওয়াজ নেই। তাই বিবাহসূত্রে বা বিবাহের পর গারো পুরুষ যদি কিছু লাভ করে অথবা শ্রমের দ্বারা কিছু অর্জন করে, তার সব কিছুরই অধিকারী হয় তার স্ত্রী, তার কন্যা অথবা তাদের আত্মীয়ারা।
তাই, বিবাহের পর উপযুক্ত কর্মক্ষম সময়ের উপার্জিত সম্পত্তির মালিকানা গারো পুরুষেরা হতে পারে না বলে তাদের আক্ষেপের সীমা নেই।
কারণ হিসাবে তারা বলেন, অবিবাহিত পুরুষ মায়ের অনুমতি ছাড়া এবং বিবাহিত পুরুষ স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া নিজের উপার্জিত বা অর্জনকৃত সম্পদ নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার (বিক্রয়/হস্তান্তর) করতে পারেন না; এবং স্ত্রীর পরিবারে থেকে উপার্জিত সম্পত্তি স্ত্রী/জিকচলদের অধিকারে থাকায় স্ত্রী মারা গেলে অথবা কোন কারণে স্ত্রীর পরিবার ত্যাগ করতে হলে নিঃস্বভাবে ফিরে এসে আমা মা.নকের (মা-বোনদের) কাছে দ্বারস্থ হয়।