রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ব্লগসগারো খাবার ও পোষাকগারো পানীয় চু এর ব্যবহার

গারো পানীয় চু এর ব্যবহার

গারো পানীয় চু সামাজিক তালিকায় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। চু বলতে গারোদের নিজস্ব তৈরী এক প্রকার পানীয়কে বুঝায়। ভিন্ন সমাজে বা ভিন্ন মতাদর্শের লোকেরা এই পানীয়কে মদ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে মদের মধ্যে যে পরিমান অ্যালকোহল এবং অন্যান্য নেশা জাতীয় উপাদান থাকে, এই পানীয়তে তা নেই বলে অনেক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ এই পানীয়কে মদের পর্যায়ে ফেলতে রাজী নন।

কেননা, গারোদের তৈরীকৃত পানীয় চুতে যে পরিমাণ অ্যালকোহল থাকে, এর থেকে অনেক অধিক পরিমাণে আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত ঔষধগুলোতেও থাকে এবং সর্দি, কাশি এবং ব্যথানাশক ঔষধগুলোতে এর বেশিও থাকে। উদাহারণস্বরূপ বলা যেতে পারে- এক চামচ বা একটা হিস্টাসিন ট্যাবলেট খেলে একটা মানুষ যেভাবে অবশ এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়, পুরো এক গ্লাস চু পান করলে হয়তো সে পরিমান অবশ বা তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে পারে।

এরকম ঔষধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আফিম, মরফিন, হিরোইন এবং ফেন্সিডিল, কোকেন, এম ফেটামিনস, জায়া জিপাম, নাইট্রাজিপাম ও ক্লোর ডায়াজিপোক্সাইড ইত্যাদি বিভিন্ন রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য তৈরী হলেও বর্তমানে নেশা হিসাবে ব্যবহারের কথা শোনা যায়। তবে এই চু (পানীয়) মাত্রাতিরিক্ত পানে মানুষ মাতাল হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে।

গারো সমাজে চু-এর ব্যবহার

মূলত: যে কোন এলোপ্যাথিক অথবা হোমিওপ্যাথিক ঔষধেও একইরূপ প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার; যদিও এই স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকতা ব্যক্তি বিশেষে তারতম্য হয়ে থাকে।

গারোদের কাছে এই চু অর্থাৎ পানীয় অতি পবিত্র অথবা পবিত্রতার প্রতীক। এই চু বা পানীয় গারোদের কাছে অতীব অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য উপাদান। কেননা গারোরা আদিকাল, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই চু অর্থাৎ পানীয়-এর ব্যবহার যে কি পরিমান অপরিহার্যতা, তা গারোদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করলেই আশা করি বিষয়টি আরোও স্পষ্ট হবে। নিম্নে গারো সমাজে চু (পানীয়) ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো-

১) শিশুর জন্মে :

আগেই বলা হয়েছে- আদিগারোদের বিশ্বাস অনুসারে চু পবিত্রতার প্রতীক। গর্ভধারন নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে গারোরা শিশুর নামে চুজাঙ্গি (অর্থাৎ জীবনপানীয়) প্রস্তুত করে। সামর্থ অনুসারে সবচেয়ে বড় দিকথম বা দিকখাতে (মাটির পাত্র) এই চুজাঙ্গি প্রস্তুত করা হয়। শিশু ভুমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে পাত্র থেকে এক ফোটা বিচ্চি (আসল রস) শিশুর মুখে বা জিহ্বায় লাগিয়ে দেওয়া হয়।

খামাল দীনেশ নকরেকের ভাষ্যমতে, খ্রিষ্টানদের বাপ্তিষ্ম বা মুসলমানদের সুন্নত করার মত এটি গারোত্ব বরণ করার একটি আদিপ্রক্রিয়া। শিশুর মাকে এবং ধাত্রীদেরকেও এই চু খাওয়ানো হয়। প্রবীণদের ধারণা, এই চু পান করলে প্রসূতির ব্যাথা লাঘব হয়। প্রক্রিয়াটি সাংসারেক ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলন থাকলেও বর্তমানকালে গারো খ্রিষ্টানদের মধ্যে শিশুকে চু খাওয়ানোর প্রচলন দেখা যায় না।

২)অতিথি আপ্যায়নে :

এই চু-এর যে কোন ধরণের বৈঠকের সময় যেমন- পারিবারিক বা সামাজিক বৈঠক, বিবাহ, শ্রাদ্ধ, বিচার ইত্যাদিতে আগতদের জন্য এই চু পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও প্রত্যেকটি পরিবার চ্রা, নকচিক এবং যে কোন অতিথির সম্মানে এই চু পরিবেশন করার রেওয়াজ এখনও প্রচলিত।

৩)মৃত দেহ স্নানে :

মৃতকে দাহ বা কবরস্থ করার আগে চু বিচ্চি দিয়ে লাশ ধোয়ানো এবং কবর বা চিতার চারপাশে ঘুরে চুবিচ্চি ছিটিয়ে শুচিকরণ সাংসারেকদের অত্যাবশ্যকীয় কর্ম। গারোদের আদিধর্ম সাংসারেকদের মৃতদের সৎকার এ পদ্ধতিতেই করে থাকে; তবে খ্রিষ্টানরা পুরোহিতের আশীর্বাদকৃত পবিত্র জল দিয়ে শুচি কর্ম সম্পাদন করে থাকে।

৪)উৎসবে :

গারোদের যেকোন উৎসবে চু ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়। যেমন- বিবাহের প্রস্তুতিতে, বিবাহ অনুষ্ঠানে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে গিম্মিন বা গুম্মুন নেওয়ার সময় দিকখা (বড় হাড়িতে তৈরী চু) নিয়ে যেতে হতো। আধুনিককালে কিছু প্রটেস্টান মণ্ডলীর লোকেরা চু ব্যবহার করেন না।

৫)পুজাবলিতে :

গারো সাংসারেক ধর্মানুসারিদের বিশ্বাস মতে, চু বা চুমান্থি দেবতার দান। সুতরাং যেহেতু আদি গারো বা সাংসারেকদের কাছে চু পবিত্রতার প্রতীক; তাই সাংসারেকদের প্রত্যেকটি দেবতার পূজা এবং পশু বা পাখি বলির সময় চুবিচ্ছি বা চেকগা উৎসর্গ করতে হয়।

৬)রোগ প্রতিরোধ বা প্রতিকার হিসাবে :

আদিগারোদের বিশ্বাস অনুসারে চু যেমন পবিত্রতার প্রতীক, তেমনই এটি ভালো দাওয়াই। সর্দি, কাশি, পেটের পীড়া, আমাশয়, বহুমূত্র, বিষাক্ত পোকার আক্রমণে, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, ধাতু দুর্বলতা বা সহবাসে অক্ষম ইত্যাদি রোগে প্রতিষেধক ও প্রতিকারের মহৌষধ হিসাবে ব্যবহার হতো। শরীরে কেটে গেলে রক্ত বন্ধ করতে এবং ব্যাথা কমাতেও ক্ষততে চুবিচ্চি দেওয়া হয়।

৭)তথ্য আদায়ে :

অতিরিক্ত চু খেলে যেহেতু নেশা হয়, তাই উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছথেকে কোন তথ্য আদায়, দোষ স্বীকার করানোর সময় কৌশলে খাইয়ে আসল তথ্য আদায় করা হতো। গারোদের বিশ্বাস, চু পান করলে কেউ চালাকী অথবা কোন তথ্য গোপন রাখতে পারে না। শুধু তাই নয়, আদিকালে বিবাহের প্রস্তাবে রাজী না হলেও ছেলেকে খাইয়ে নেশার ঘোরে রাজী করানো হতো বা যুবতীর ঘরে থাকতে বাধ্য করা হতো ।

৮)সমস্যা সমাধানে বা কর্ম সম্পাদনে :

পরিবার বা সমাজের যে কোন ধরণের বড় কাজে লোকজনকে অংশগ্রহণ (এলাকাভেদে এ পদ্ধতির বিভিন্ন নাম; যেমন- রিমগ্রিমা, বারাগ্রিকা, মাংনা কামলা ইত্যাদি) করিয়ে অল্প সময়ে কাজ সম্পন্ন করার উপায় এই চু। একবেলা ভাতের সাথে চু খাওয়ালেই সকলে মিলে খুশিমনে কাজগুলো করে দিতো।

৯)শত্রু দমনে :

চু-এর স্বাদ এবং গন্ধে আকৃষ্ট হয় এমন কিছু কিছু পোকামাকড় রয়েছে। এগুলোকে ধরার ফাদ হিসাবে চু ফেলে রাখা হতো, ওগুলো খেয়ে বা গন্ধে নেশাগ্রস্ত হলে সেগুলো মেরে ফেলার ভালো উপায় হিসাবে চু ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্যদিকে ক্রোধ বশতঃ শত্রুকে ঘায়েল করতে অথবা চু এর সাথে আরাগিত্থাং বা আরাগিসি খাওয়ানো হতো।

১০)ক্লান্তি ও অবসরে :

কঠিন কাজে শক্তি যোগাতে বা কাজের ফাঁকে, বিশ্রামে শরবতের বিকল্প হিসাবে চু-এর ব্যবহার এখনও পরিলক্ষিত হয়। পরিবারে বা পাড়ায় সন্ধ্যায় বা অবসরে সকলে মিলে সময় কাটানোর উত্তম উপায় হলো একটা চু-দিকখা। অতীতে বন্যজন্তু শিকারে শক্তিবর্ধক হিসাবে চুবিচ্চি পান করা হতো।

১১) সম্মান ও সুনাম বাড়াতে :

যে যত বড় দিকথম বা দিকখায় চু প্রস্তুত করবে এবং যত বেশি চু-এর বয়স হবে, সে অনুসারে তার সুনামও বৃদ্ধি পাবে। সেসাথে যার চুএর স্বাদ এবং গন্ধ ভালো হবে, চু-এর প্রস্তুতকারিনীও তত বেশি প্রশংসার দাবীদার।

১২)নেশা হিসাবে :

চা-পানে আসক্ত ব্যক্তিরা যেমন চা-পান ছাড়া থাকতে পারে না, যারা চুকে নেশা হিসাবে পান করে- তাদের অবস্থাও এমনই। বিভিন্ন কারণে দুশ্চিন্তা, কষ্ট-দুঃখ ভুলে থাকার জন্য চু নেশা হিসাবে গ্রহণ করে থাকে।  যাদের ঘুম কম হয় তারাও এই চু পান করে থাকে।

চুপরিবেশনের প্রক্রিয়া এবং আচার

চু প্রস্তুত এবং পরিবেশনের প্রক্রিয়া- যে স্থানে চু দিকথম নিয়ে চু প্রস্তুত করে তাকে বলা হয় দিকখল। যিনি চু প্রস্তুত করেন তাকে বলা হয় দুচেকগুবা। প্রথমে চুচেকগুবা দিকথমের (চু পাত্র) ঢাকনা খুলে জান্তি বরাবর যেটুকু স্থি বা ভাতের সমপরিমান পানি ঢেলে দিতে হয়।

তারপর ফং দিয়ে পানি তুলে স্থি-এর উপর ঢেলে দিতে হয়। এভাবে তোলা-ঢালা করতে করতে চু পানের উপযোগী হয়। তারপর আরেকটি পাত্রে (অনচাক্রা বা দনচাক্রা) জমিয়ে পরে সেটি বড়  ফং অথবা জগ (যাকে বলা হয় রনচাক্রা) দিয়ে সবার জন্য নির্ধারিত গ্লাসে (যাকে বলা হয় দাম্বি) ঢেলে দিতে হয়। চু পানের সময়েও গারোরা কিছু আচার মেনে চলে ; যেমন-

  • সাধারণত যেকোন চু পানের সময় সকলেই গোল হয়ে বসেন।
  • চ্রা এবং মুরুব্বী শ্রেণীর লোকজন দিকখলের কাছে এবং ডানপাশে সারিবদ্ধ হয়ে বসবেন।
  • চুচেকগুবা চু প্রস্তত করার সময় দিকথমে তার হাঁটু স্পর্শ করতে পারে না।
  • চু চেকগার সময় যাতে চু/পানি ঢালা/তোলার শব্দ যেন না হয়।
  • সর্বপ্রথম বাড়ির কর্তা, তারপর সবচেয়ে মুরুব্বী এবং চ্রাদেরকে চু পরিবেশন করতে হয়।
  • চু পরিবেশনের শুরুতে বিনয়ের সাথে পান করতে প্রস্তাব দিয়ে একই গ্লাসে সকলের জন্য ফং থিসা বা এক গ্লাস করে খাইয়ে দিতে হয়।
  • সর্বপ্রথম চু পান করানোর সময় অবশ্যই আগে ফং বা গ্লাস থেকে কয়েক ফোটা করে মাটি এবং দেবতাদের উদ্দেশে অল্প পরিমানে মাটিতে ফেলে তারপর খাওয়াতে হয়। তারপর উপস্থিত লোকজনকে খাওয়ানোর নাম- খানচিকা। এরপর উপবেশনকারি দাম্বি (সবার জন্য একটি করে নির্দিষ্ট গ্লাস) ভরে চু ঢেলে রেখে যেতে হয়।
  • যিনি চু বিতরণ করছেন বা পান করাচ্ছেন তাকেও একগ্লাস বা কিছু পরিমান খেতে অনুরোধ করা বা খাইয়ে দেওয়া ভদ্রতার পরিচায়ক।
  • খাজি প্রস্তুত হলে আগে অল্প খাজি (১/২ মাংসের টুকরো) খাইয়ে তারপর চু এক গ্লাস খাওয়াতে হয়।
  • যতোই তৃষ্ণা বা সক্ষম হোক না কেন, একবারে দাম্বির পাত্র বা গ্লাস খালি করে খাওয়া অশোভন ও অসম্মানজনক।
  • দাম্বির (ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত) গ্লাসের চু শেষ হওয়ার আগেই সেই গ্লাস ভরে চু ঢেলে দিতে হয়।
  • অনেকে চু কম খান, সেক্ষত্রে আর খাবেন না বলে গ্লাস একবারে খালি করে খাওয়া অশোভন। না খেলেও বা খেতে না পারলেও নিজের গ্লাসে চু রেখে দিতে হয়।
  • খাওয়ার আসর থেকে কেউ চলে যেতে চাইলে সবাইকে জানিয়ে (বা বিদায় নিয়ে) নিজের গ্লাসটি দিকখলে জমা দিয়ে যাওয়া ভদ্রতার লক্ষণ।
  • দায়িত্ব শেষ না করে বা সকলের চলে না যাওয়া পর্যন্ত চু-চেকগুবা চলে যেতে পারেন না।  যদি স্থান ত্যাগ করতেই হয়, তাহলে অন্য একজনকে বসিয়ে তারপর যেতে পারবেন।
  • অকারণে অপ্রাসঙ্গিক কথা উত্থাপন করে খাওয়ার আসরে গোলযোগ সৃষ্টি করা অমার্জনীয় অপরাধ।
  • চু খাওয়ানো বা খাওয়ার সময় (অথবা কোন কারণে স্থান পরিবর্তনকালে) অসতর্কভাবে কারোর গ্লাসের চু বা গ্লাস, খাজি ইত্যাদি ফেলে দেওয়া, কারো শরীরে বা পায়ে পা দিয়ে স্পর্শ বা আঘাত করা চরম অপরাধ।
  • খাওয়ার স্থানে, কারোর বাড়িতে চু খেয়ে মাতলামি করা এবং বমি, প্রস্রাব, পায়খানা করে ফেলা অমার্জনীয় অপরাধ, একারণে অর্থদণ্ডও হতে পারে।
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য