রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ব্লগসগারো নৃত্য নাট্য

গারো নৃত্য নাট্য

গারো নৃত্য নাট্য/গীতের মধ্যে রয়েছে- রোয়া/আনসেঙা, গুরি রোওয়া, গ্রিকা, গীত রিংসলা, আজিয়া, রেরে, সেরেঞ্জিং, সিমাসা ফিয়া ইত্যাদি।

নিম্নে গারো নৃত্য নাট্য/গীত নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো

) গ্রিকা

বনেজঙ্গলে বসবাস করার কারণে বন্য হিংস্র প্রাণী আক্রমণরোধে, অপ্রাকৃত আত্মা বা ভূতপ্রেত, শয়তানের মোকাবেলা করতে এবং বিরোধী, অত্যাচারী ও শত্রুদের মোকাবেলা করতে তথা প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে যুদ্ধ করতে করতে গারোরা জাতিগতভাবেই সাহসী, বলশালী ও দুর্দমনীয়। তাই গারোরা তাদের বীরত্ব প্রকাশের জন্য বিভিন্ন সানাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহে বাজনার তালে তালে গ্রিকা পরিবেশন করে থাকে। এই গ্রিকা কয়েক প্রকারের। যেমন-

  • যুদ্ধ প্রদর্শন- ভিন্ন জাতি, স্বৈরশাসক, বিরোধী দল, অত্যাচারী, ডাকাত ও শত্রুদের মোকাবেলা করতে মিল্লাম স্ফি নিয়ে গারোরা প্রায়ই সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হতো। কিভাবে যুদ্ধ করতো বা বহিঃশত্রুর মোকাবেলা করতো, সেটাই গারোদের যেকোন অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়। মূলত এটাকেও গ্রিকা বলা হয়।
  • রামা দিল্লা- আদিগারোরা যাযাবর হিসাবেও খ্যাত। খাদ্যাভাব, অশান্তি পরিবেশথেকে মুক্তির লক্ষ্যে এরা এক জায়গাথেকে অন্য জায়গায় চলে যেতো। বহিঃশত্রুর মোকাবেলা এবং গভীর বন জঙ্গলের হিংস্র জীবজন্তুর হাতথেকে পরিবার বা গোষ্ঠীকে রক্ষা করতে দলনেতা মিল্লাম স্ফি নিয়ে সবার আগে অগ্রসর হতো- এটাকেই বলা হয় রামাদিল্লা। এখনও গারোরা র‍্যালী করার সময় রামাদিল্লা প্রদর্শন করে থাকে।
  • মাং রিক্কা- মাং-রিক্কা শাব্দিক অর্থে মন্দ আত্মা, শয়তান বা ভূতপ্রেত ইত্যাদিকে তাড়ানো। লাশ দাফনের উদ্দেশে বাড়িথেকে বের করার সাথে সাথে মৃতের চ্রা (মামা, ভাইয়েরা) এই মাং-রিক্কা করে থাকেন। সাধারণত শুধুমাত্র লাশ দাফনের সময়েই এটি করা হয়ে থাকে।

) ঝুমচাষ নৃত্য

সালাম খাআ (শুভেচ্ছা জ্ঞাপন):

কোনো নৃত্যের শুরুতেই দর্শক সমাবেশ বা সমাগত সকলকে শুভেচ্ছা বা অভিবাদন জ্ঞাপন করা হয়। গারো নৃত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অন্যকে সন্মান জানানো।

দো.মি সুয়ালা (মোরগের পালক বিতরণ):

নৃত্য পরিবেশনের জন্য দো.মি বা একধরণের অলংকার মরগির পালক দিয়ে যা তৈরি তা সকলের মধ্যে বিতরণ করা হয়। নৃত্যের জন্য সকলেই প্রস্তুত তা এখানেই দেখানো হয়। দো.মি পরিধনে গারো রমণীদের অপূর্ব লাগে।

নমিল খাম্বি থোয়া (উচ্চতা মাপা):

গারো নৃত্যের অন্যতম অংশ হলো পরস্পরের উচ্চতা পরিমাপ করা। নৃত্য পরিবেশনের জন্য উচ্চতা মাপা বিশেষ গুরুত্ব বয়ে আনে। এতে সুশৃঙ্খলভাবে নৃত্য পরিবেশন করা যায়। এই নৃত্যে সময় যুবতীরা একে অন্যের সঙ্গে আপন আপন উচ্চতা দেখে নেয়।

চু খান্না (মদ পরিবেশন):

গারোদের ঐতিহ্য হলো অতিথি আগমন ঘটলে তাকে ভাতের তৈরি চু বা মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। অতিথি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আসন গ্রহন করানো হয়। বাড়ির আশেপাশের লোকদের ডাকা হয় এবং তখন উত্তম মানের চু বিচ্চি পরিবেশন করা হয়। কোনো এলাকায় দামা বাজিয়ে নৃত্যের তালে তালে অতিথিকে এক এক করে এই গু পরিবেশন করা হয়। নৃত্যে তালে তালে চু পরিবেশন করানো হলে আগত অতিথি সন্মান বোধ করেন।

আগাল সোআ (জঙ্গল পোড়ানো):

নাচের তালে মেয়েরা যার যার জায়গায় জঙ্গল বা আবর্জনা স্তূপাকারে রাখার অভিনয় করবে, আর পরবর্তীতে ছেলেরা তাতে আগুন দেওয়ার অভিনয় করবে।  

মি গিআ/খিল ফুয়া (তুলা বীজ বপন):

গারোরা ঝুম চাষের সময় পাহাড়ে তুলা চাষ করত। ঝুমের জন্য নির্বাচিত জমি জঙ্গল পরিষ্কার করে পুড়িয়ে সারযুক্ত জমি তৈরি করা হতো। বীজ বুনন কৌশল খুবই আকর্ষণীয়। গাছের লম্বা ডাল কেটে চিকন করে ধারালো করা হয় এক অংশ। চোখা ও ধারালো অংশ দিয়ে মাটি খুঁড়ে তুলা বীজ বপন করে মাটি ঢেকা দেয়া হয়। বৃষ্টি হলে অংকুরিত হয়ে তুলা গাছ জন্মে। তুলা যখন বড় হয়ে ফলন দেয় তখন তা সংগ্রহ করে সুতা কেটে কাপড় বুননের কাজে ব্যবহার করা হয়। গারো ঐতিহ্য অনুসারে নৃত্যের তালে তালে বাদ্য বাজিয়ে তুলা চাষাবাদ দেখানো হয়। বংশপরম্পরায় এভাবে তুলা চাষ গারোদের মাঝে আজও বেচে আছে। এভাবে জাতিগত প্রথাগত ধারা পরবর্তী প্রজন্ম ধারণ করে আসছে ঐতিহ্যগতভাবে।

মি-রাত্তা/ মিআককা (ধান কাটা):

মিমান্দি ধান উচু হয়ে থাকে, সেটি কাচি দিয়ে ধান কেটে মাথার ঝুড়িতে রাখার অভিনয় করবে।

মি নাক্কা (ধান মাড়াই):

বাদ্যযন্ত্রের তালে মেয়েরা পা নিয়ে ধান মারাইয়ের অভিনয় করবে, আর ছেলেরা দামা বাজাতে বাজতে ধান এনে মেয়েদের পায়ের কাছে রাখবে।

মি সোআ (ধান ভানা):

ধান ভানা গারোদের অতি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া দৈনন্দিন খাদ্য রান্নার জন্য।ধানের শীষ গোলা থেকে বের করে পা দিয়ে মাড়িয়ে ধান শীষ থেকে পৃথক করা হয়। আতপ চাল গারোদের খাওয়ার অভ্যাস। তাই ধান ভানার জন্য সিদ্ধ করতে হয় না। ধান ভানার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রকে রিম্মল ও চা’আম বলা হয়। চা.আম কাঠের গোরা খোদাই করা গর্ত। এই গর্তে ধান ফেলে রিম্মল দিয়ে আঘাত করে ধানের খোসা আলাদা করা হয়। এভাবে ধান ভানার কাজ সমাপ্ত করা হয়। গারোদের এই পদ্ধতিতে ধান ভানাকে নৃত্যের তালে তালে উপস্থাপন করা হয়। দামা বাজিয়ে যখন রিম্মল ও চা.আম দিয়ে ধান ভানা দেখানো হয় তখন অনেকেই স্মৃতি চারন করেন অতীতের কথা। খুবই আকর্ষনীয় পদ্ধতিতে মি সো.আ নৃত্য প্রদর্শন করা সকলের মনোরঞ্জন করতে সমর্থ হয়।

মেগারু দেন্না (ঢেউদানা আহরন করা):

গারোরা জুম ক্ষেতে অনেক ধরনের ফসল চাষ করে এক সঙ্গে। মেগারু হলো ঢেউদানা শষ্য। উচ্চতায় চার পাচ ফুট লম্বা হবে গাছটি। এই মেগারু কাটার জন্য দলে দলে রমণীরা জুমে যায় এবং নৃতের তালে তালে একাবদ্ধ হয়ে কেটে সংগ্রহ করে। এই মেগারু কাটার দৃশ্য নৃত্যের মাধ্যমে দেখা যায়।

আমব্রি রুরুয়া (আমলকি পাড়া):

গারোদের নৃত্যের একটি বৈশিষ্ট্য হলো নারী পুরুষের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক নৃত্য করা। যুবকেরা যুবতীদের আমলকী পেড়ে দিতে অতি আনন্দসহকারে। এই আমলকী পাড়া নৃত্যের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হতো।

নমিল হাবুয়া (যুবতিদেরর স্নান):

গারোদের পাহাড়ি ঝর্ণায় গিয়ে দলবদ্ধভাবে স্নান করা অত্যন্ত প্রিয়। তারা সারাদিন ঝুম খেতে কাজ সেড়ে সন্ধ্যা বেলা স্নান করতে যায়। সঙ্গে কাপড় ধোয়ার কাজ করে। পাহাড়ি ঝর্না তাদের অত্যন্ত প্রিয় জায়গা স্নান করার জন্য। গারোদের এই দৃশ্য নৃত্যের মাধ্যমে প্রর্দশন করা হয়। মেয়েরা দলীয়ভাবে এই নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। তাদের সঙ্গে পুরুষেরা দামা, রাং ও আদুরু বাজিয়ে তাদের সাহস জোগায় ও উৎসাহ দিয়ে থাকে।

গুরি রোওয়া:

ঝুমচাষ নৃত্যের এটাই শেষ আইটেম। ঘরে ফসল তোলা, ধান মাড়াই এবং ধান ভানার পর সবাই মিলে দামা রাং ক্রামের তালে তালে গোল হয়ে নাচে।

এছাড়াও বাড়তি অংশ হিসাবে আরও প্রায় পঞ্চাশটি আইটেম নৃত্য প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। যেমন-

দো.ফিত রিক্কা (বাবুই তাড়ানো):

ঝুম খেতের ফসল যখন পাকা শুরু হয় তখন নানা পশু পাখি সেই ফসল খাওয়ার জন্য আসে। বিশেষ করে বাবুই পাখি বেশি ফসল নষ্ট করে। তাই গারোরা সেই বাবুই পাখি তাড়ানোর কাজে পাহারায় থাকে। পাহারা দেওয়ার সময় একা একা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্ত হয়ে পড়লে পাড়া প্রতিবেশী বা বোনকে দলবদ্ধ হয়ে পাখি তাড়ানোর জন্য আহ্বান জানায়। এই আহ্বান জানানো ও পাখি তাড়ানোর কৌশল নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। অতি নিখুঁতভাবে দো.ফিত রিক্কা বা পাখি তাড়ানোর নৃত্য পরিবেশন করা হয়।

দো.দি মেসা (ময়ূর নৃত্য):

দো.দি হলো ময়ূর। বনে ও পাহাড়ি ঢালুতে ময়ূর বিচরণ করত তার পেখম মেলে। ময়ূরের পেখম মেলে নৃত্য এক মনোরম দৃশ্য। গারো রমণীরা ময়ূরের নৃত্য অনুকরন করে নিজেরা তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করে। একজন ময়ূর সাজে বাকি রমণীরা তাকে কেন্দ্র করে নৃত্য করতে থাকে।

দো গোয়া (পাখি শিকার):

পাখি শিকার গারোদের ঐতিহ্যবাহী পেশা। তারা বিভিন্ন ধরনের পাখি শিকার করে আহার করতো। তাদের আমিষের একটি অংশ পাখির মাংস দিয়ে তারা পূরণ করতো। বিনের ফল-মূল, শা-সবজি, ইত্যাদি সংগ্রহ করে আহার যোগাড় করা তাদের নিত্যদিনের কাজ। বুনো ফুল তুলে মেয়েদের খোঁপায় গুঁজে দিত যুবকেরা। নানাভাবে তারা আনন্দ তামাশা করত একে অন্যের সঙ্গে। পাখি শিকারের এই দৃশ্য নারী-পুরুষ মিলে নিত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করে দলীয়ভাবে। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে এই নিত্য পরিবেশন করা হয়।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য