গারো জাতির নামাকরণ নিয়ে এখনও রয়েছে নানা অভিমত। অনেকে বলেন, পূর্বে আ’চিকদের (গারোদের) পূর্ব পুরুষগণ তিব্বতে ছিলেন। সেখান থেকে তারা গারোয়াল নামক পাহাড়ে এসে কিছুকাল বসবাস করেন। এ গারোয়াল পাহাড়ে বসবাস করাকালীন সময়েই এই জাতির লোকেরা মহাদুর্ভিক্ষের সময় পশুর চামড়ায় লিখিত তাঁদের মহামূল্যবান পুস্তকসমূহ সেদ্ধ করে খাওয়ার পর তাঁদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের দলিল প্রমাণাদি চির তরের জন্য হারিয়ে ফেলেছেন।
গারো জাতির নামাকরণ ইতিহাস
গারোদেরই বিভিন্ন কথা-কাহিনী হতে আরও জানা যায়, প্রাচীনকালে সঙ্গল নামে এক গারো বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ে কিছুকাল রাজত্ব করেছিলেন। মণিন্দ্রনাথ মারাক তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, প্রায় অধিকাংশ মুসলিম ঐতিহাসিকগণ- ফিরিস্তা, মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ, গোলাম হোসাইন সলিম প্রমুখ এবং ইংরেজ ইতিহাসবিদ এডুয়ার্ড গেইট এই সঙ্গল বা সঙ্গলদের রাজত্বের কথা স্বীকার করেছেন।
এই সঙ্গল রাজার রাজধানী গৌড় হতে গারো নামের উদ্ভব হয়েছে। এই বিষয়ে নীবিড়ভাবে আরও গবেষণা করলে হয়তোবা আরও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে।
বরেণ্য লেখক মণিন্দ্রনাথ মারাক তাঁর গারো নামের ইতিবৃত্ত প্রবন্ধে আরও মতামত বা মতবাদ তুলে ধরে গারোদের আদি ইতিহাস এবং নামাকরণের যৌতিকতা তুলে ধরেছেন। তবে অধিকাংশ গারোই নিম্নোক্ত যুক্তিটাকে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।
মঙ্গোলীয় নাম
সেখানে তিনি লিখেছেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রাগজোত্যিষপুরের প্রথম যে রাজার নাম পাওয়া যায়, তাঁর নাম মৈরাং। যা এটি একটি মঙ্গোলীয় নাম।
পরবর্তীকালে হিন্দু লেখকগণ তাঁর নাম দেন মহিরঙ্গ দানব। এই দানব বংশীয় লোকেরাই পরবর্তীকালে কিরাত জাতি বলে প্রসিদ্ধি লাভ করে। প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনের রাজা বাসুদেব ও প্রাগজ্যোতীষপুরের রাজা ভগদত্ত বিরাট কিরাত বাহিনী নিয়ে কৌরব পক্ষে ভারত মহাসমরে (কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে) যোগ দেন।
মহাদেব শিবের বংশ
গারোদের গল্প কাহিনী হতে জানা যায় যে, মহাদেব (শিব) গারো মেয়ে নাবারিতা দিপারী-কে বিবাহ করেছিলেন। কোচদের কাহিনীতেও জানা জানা যায়, মহাদেব কোচ মেয়ে হিরা ও জিরা-কে বিবাহ করেছিলেন। এই জন্য কোচ ও গারোরা নিজেদের মহাদেব শিবের বংশ বলে থাকে। মহাদেব ছিলেন কিরাত জাতির লোক।
রামায়ণের শ্লোক
অন্যদিকে গারোদেরকে কিরাত জাতির যৌক্তিতার পক্ষে রামায়ণে গুরুত্বপূর্ণ একটি শ্লোক রয়েছে। রামায়ণের সে শ্লোকটি হুবহু নিম্নে তুলে দেওয়া হলো-
ব্রহ্মপুত্র তরি রঙ্গে করিছ প্রবেশ
মন্দর পর্বতে যাইও কিরাতের দেশ।
যাইবে দশটি দেশ আর সাকদ্বীপে
কিরাত জানিবা আছে অত্যদ্ভুত রূপে।
কনকচাঁপার মত শরীরের বর্ণ
উঠানখানার মত ধরে দুই কর্ণ।
থালাহেন মুখখান তাম্রবর্ণ কেশ
একপায়ে চলে পথ বিক্রমেতে বিশেষ।
জলের ভিতর বৈসে মৎসবৎ মুখ
মানুষ ধরিয়া খায় আইসে সম্মুখ।
বলিয়া মানুষ-ব্যাঘ্র তাঁদের খ্যাতি
আতপ সহিতে নারে কিরাতের জাতি।
সীতা লৈয়া থাকে যদি কিরাতের ঘরে
যত্ন করি চাহিও তথায় লংকেশ্বরে।
সীতা লৈয়া থাকে যদি কিরাতের ঘরে
যত্ন করি চাহিও তথায় লঙ্কেশরে।।
গারো পাহাড়
তিনি বলেন, এখানে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড় হওয়ার পর যে পাহাড় সম্মুখে পড়ে তাই গারো পাহাড় এই গারো পাহাড়ের একটি চূড়ার নাম কোয়াশিমিন্দ্রি। এই মিন্দ্রিকেই মন্দর বলা হয়। এছাড়াও মন্দর পর্বতের আরও দুটি নাম পাওয়া যায়। একটি হিমালয়ে অপরটি গঙ্গার দক্ষিণে বিহারের ভাগলপুর জেলায়। এ দুটি পর্বতে যেতে হলে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হতে হয় না।
সুতরাং ঐ মন্দর পর্বত গারো পাহাড়কেই বুঝিয়েছে এবং গারোকেই কিরাত জাতি বলা হয়েছে। উক্তি বর্ণনায় কানকে উঠানের মতো বলা হয়েছে। কারণ, প্রাচীন গারোরা কানের উপরে ও নীচে অনেক ভারী অলঙ্কারাদি পরতো বলে কান বড় দেখাতো। তদুপরি পূর্বে গারোদের বিশ্বাস ছিলো- গারোরা দিনে মানুষ হয়ে, রাত্রে বাঘ হতে পারতো বা একই সময়ে মানুষ ও বাঘ এই দুই জীবনের অধিকারী হতো। গারো ভাষায় একে বলা হয় বাৎছাদু-মাৎছাবেদ।
অনেক দেশি-বিদেশি, গারো, অগারো যারা গারোদের নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিবর্গের সকলেই একমত- মহাভারত, কালিকাপুরাণ ও যোগিনীতন্ত্রে কিরাত বলে যে জাতিকে উল্লেখ করা হয়েছে, তারাই এখন গারো নামে পরিচিত। বৃটিশ আমলের শুরুর দিকে আসামের সমস্ত আদিবাসী/উপজাতিকে (কাছারি, লুসাই, নাগা) জাতিকে গারোই বলা হত।
গারো গবেষক, লেখক মণিন্দ্রনাথ মারাক এর মতামত
গারো গবেষক, লেখক মণিন্দ্রনাথ মারাক তাঁর গারো নামের ইতিবৃত্ত প্রবন্ধে বলেছেন, প্লিনি গারো পাহাড়কে মালেয়াস পাহাড় এবং এই পাহাড়ের আদিবাসীদের মান্দাই (মান্দে>মান্দাই>মান্দি>মানুষ) বলেছেন (ম্যাগাস্টেনিস এরিয়ান)। টলেমির ভূগোল পুস্তকে কিরাত জাতির সঙ্গে গারিওনি জাতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি গারো পাহাড়কে মৈরন্তুম পর্বত বলেছেন।
তিনি হয়তো রামায়নে উল্লেখিত মন্দর বা মিন্দিরকে মৈরন্তুম পাহাড় বলেছেন। তিনি পাতালিপুত্র থেকেই এই অঞ্চলের তথ্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন। তাই জাতির নাম ও স্থানের মানগুলি অপভ্রংশ হয়েছে। খুব সম্ভব গারো নাম লোকমুখে শুনে এবং অপভ্রংশ করে গারো শব্দকে গারিওনি লিখেছেন।
টলেমীর জীবনকাল খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দী। আর প্লিনি যিনি ন্যাচারাল হিষ্ট্রিতে গারোদের মান্দাই বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর জীবনকাল ছিলো খ্রিষ্টীয় ১ম শতাব্দী।
উপসংহার
এছাড়াও গারোদের সম্পর্কে এলাকার সবচেয়ে প্রবীণ ব্যাক্তিবর্গের সাথে আমরা আলাপ-আলোচনা করে গারো জাতির আদি ইতিহাস, উৎপত্তি সম্পর্কে আরও তথ্য যাচাইয়ের চেষ্টা করেছি। তাঁরা হলেন, খামাল দীনেশ নকরেক (৯০বঃ), খামাল জনিক নকরেক, নিশিকান্ত মাজি (৮৫বঃ) প্রমূখ। উনারা সকলেই একবাক্যে বলেছেন, গারোদের পূর্ব পুরুষগণ তিব্বত থেকেই গারো নাম নিয়েই এসেছে।
পরবর্তীতে গারো পাহাড়ে এসে বসবাস করার কারনে বর্তমান মেঘালয় রাজ্যের গারো হিলস জেলা ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে গারোয়ানা নামেই স্থাপিত হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এ জেলার নাম গারো হিলস রাখা হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এই গারো পাহাড়টির নাম গারোদেরই দেওয়া। তারপর ভৌগলিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার কারণে গারোরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিলো।