গারোদের সম্পত্তি আইন এ গারো সমাজে মেয়েরাই পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারিনী হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পুরুষেরা কোনভাবেই পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না, এমনকি বিয়ের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত বা কোন কারণে স্ত্রী বিচ্ছেদের কারণে পিতামাতার কাছে অবস্থানকালে কোন পুরুষ তার পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ, অর্থকরিও নিজের বলে দাবী করতে পারে না।
পৃথিবীর প্রায় সকল জাতির মধ্যে অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে পুরুষদেরকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে; অন্যদিকে মহিলারা অনেকটা পুরুষদের অনুগ্রহ বা ছাড়া দেওয়ার উপর নির্ভরশীল। অন্যান্য জাতির মধ্যে উত্তরাধিকারের বংশধারা পিতার দিক হতে গণনা করা হয়; মায়ের দিক হতে গণনা করা হয় না, কিন্তু গারো সমাজের প্রচলিত প্রথা বা আইন এর বিপরীত।
তবে আধুনিককালের প্রায় সকল পিতামাতা শিক্ষিত হওয়ায় এবং অন্যান্য জাতির উত্তরাধিকার আইনে প্রভাবিত হয়ে পারিবারিক সম্পদের উত্তরাধিকারে মেয়ে সন্তানের পাশাপাশি ছেলেদেরকেও দান করছে।
গারোদের সম্পত্তি আইন
যেকোন দেশের বা সমাজের আইন কটূক্তি করা, অবমাননা করা, অবমূল্যায়ন করা কোন সমাজবিজ্ঞানী বা লেখক, গবেষকদের কাজ নয়। সকল ক্ষেত্রে আইন যেমন রয়েছে, তেমনই আইনেরও ফাঁক থাকতে পারে; তেমনই সেই আইনকেও কেউ কেউ নিজস্বার্থে ব্যবহার (বা অপব্যবহারও) করতে পারে।
অর্থাৎ কোন আইনের যেমন ভালোমন্দ দিক থাকতে পারে, আলোচনা সমালোচনা হতে পারে, তেমনই গারোদের উত্তরাধিকার আইন নিয়েও আলোচনা সমালোচনা হতে পারে, এ আইনগুলোর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে।
সেক্ষেত্রে আধুনিক সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে যার যা করণীয় তা সকলকেই ভাবতে হবে, সেগুলোকে সামগ্রিকভাবে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিমার্জন বা পরিবর্তন করা যেতে পারে- তাহলেই হয়তোবা যেকোন সমাজের, পরিবারের এবং ব্যক্তির উন্নয়নে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে। তবে, এযুগের তরুণ প্রজম্মকেই এরূপ দায়িত্ব নিতে হবে।
এই আলোচনায় আমরা সেদিকে যেতে চাই না। বরঞ্চ, জবাং ডি মারাক-এর Garo Law এবং রেভাঃ সি ডি বলডুইন সংকলিত Garo Law গ্রন্থ অবলম্বনে বাংলাদেশের গারো গবেষক সুভাষ জেংচাম বাংলা ভাষায় অনূদিত গারো আইন গ্রন্থে গারোদের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আইনগুলো কোন প্রকার সংশোধন বা পরিবর্তন ছাড়াই এখানে হুবহু উল্লেখ করছি-
ভূ–সম্পত্তি সংক্রান্ত উত্তরাধিকার আইন
পূর্ব পুরুষদের দ্বারা অধিকৃত এবং মালিকানানুযায়ী গারোদের জমি-জমা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত এবং বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে থাকে।
ক্রমিক নং- ৩৯, আকিং :
আকিং বা এলাকা বলতে আবহমানকাল হতে পারিবারিকভাবে অধিকৃত ভূসম্পত্তিকে বুঝাবে। বংশানুক্রমে এই সম্পত্তির উত্তরাধিকারীত্ব মা হতে মেয়েতে বর্তাবে।
ক্রমিক নং- ৪০, আমাতে (হস্তান্তরিত ভূসম্পত্তি) :
এই ধারায় আকিং নক্মা কর্তৃক কারো উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে কিছু এলাকা দান করে হস্তান্তর করাকে বুঝাবে। এক্ষেত্রে আকিং নক্মা উক্ত দানকৃত এলাকার উপর তার সমস্ত কর্তৃত্ব এবং অধিকার প্রত্যাহার করে নিবে, যার ফলে নতুন মালিকের উপর ঐসব অধিকার ও কর্তৃত্ব পূর্ণমাত্রায় বর্তাবে।
ঐক্ষেত্রে বর্তমান মালিক আমাকে নক্মা পরিচিত লাভ করবে। অবশ্য বর্তমানে এই নামাকরণে কোন পার্থক্য নাই। বর্তমানে সকল প্রকৃত নক্মাই আকিং নক্মা হিসাবে পরিচিত।
ক্রমিক নং- ৪১, আমিল্লাম্ (তরবারি দ্বারা অর্জিত ভূসম্পত্তি) :
আমিল্লাম্ মানে যুদ্ধ জয়ের দ্বারা অধিকৃত জমিকে বুঝাবে। কোন নক্মা কর্তৃক যুদ্ধে অন্য নক্মাকে পরাজিত করে তার ভূসম্পত্তি দখল করে নিলে আমিল্লাম্ হিসাবে গণ্য হবে। অন্যদিকে সরকারী খাস জমিকেও আমিল্লাম্ বুঝায়। এ জাতীয় জমি যে কেউ তার নিজের জন্য এবং তার পরিবারের লোকজনের জন্য অধিকার করে নিতে পারে এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করতে পারে।
এরকম জমি যদি আয়তনে বড় হয়ে থাকে তবে আকিং নামে অভিহিত হতে পারে এবং এর মালিককে নক্মা অভিহিত করা যাবে। বর্তমানে এরকম জমির মালিককে নক্মা বলে অভিহিত করা হয়না বটে কিন্তু প্রকৃত নক্মার সকল ক্ষমতা এবং সুবিধাদি তারা ভোগ করে থাকে।
ক্রমিক নং- ৪২, নক্নি আবা (গৃহকর প্রদানযোগ্য জমি) :
গারোরা ঝুম পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে থাকে। ঝুম চাষের জন্য প্রতিটি পরিবারকে একেকটি খন্ড জমি প্রদান করা হয়। ঐরকম অনেকগুলো জমির সমন্বয়ে আকিং গঠিত হয়। সাধারণত: ঝুম পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে প্রতিবছর নূতন নূতন জমি পরিবর্তন করতে হয়, তা না হলে জমিতে রীতিমতো ফসল উৎপন্ন হয় না।
কিন্তু কোন কোন জমির অত্যধিক উর্বরতার কারণে ফসল ভাল জন্মালে এবং জমিটি বসবাসের উপযোগি হলে সেখানে অনেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করে এবং স্বাভাবিকভাবেই জমিটি তাদের দখলে চলে যায় ও বংশানুক্রমে ভোগ দখলের অধিকার স্বীকৃত হয়।
অবশ্যই ঐ জাতীয় জমি কোনরকম হস্তান্তরযোগ্য নহে। জমির ভোগ-দখল বাবদ কোন খাজনা তাদেরকে দিতে হয় না কিন্তু গৃহকর বাবদ তারা প্রতিবছর সরকারকে কিছু টাকা প্রদান করে থাকে। ঐ জাতীয় জমির উপর মাহারীর কোন অধিকার অথবা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ঐ শ্রেণীর জমিকে নক্নি আবা বলা হয়।
ক্রমিক নং- ৪৩, সরকারী আবা (খাজনা প্রদানযোগ্য ভূসম্পত্তি) :
আকিং এলাকার জমি ব্যতিত জেলার অন্যান্য জমি সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে। এর কিছু অংশ সংরক্ষিত বনভূমি, কিছু অংশ স্থানীয় অধিবাসীদের দখলে এবং কিছু অংশ ব্যক্তি বিশেষকে বন্দোবস্ত দেয়া হয়ে থাকে। এ ধরণের বন্দোবস্তকৃত জমিকেই স্থায়ীভাবে ধানচাষোপযোগি জমি বলা হয় এবং ঐসব জমির মালিকরা নিজের ইচ্ছানুযায়ী যে কোনরকম হস্তান্তর অথবা বিক্রি করতে পারে।
পূর্বোক্ত ধারায় বর্ণিত গৃহকর প্রদানযোগ্য জমিকেও সরকার ইচ্ছা করলে আকিং নক্মার নিকট হতে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে এবং জনসাধারণের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার আকিং নক্মাকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে এবং উক্ত জমির বন্দোবস্ত গ্রহণকারীকে কবুলিয়ত পাট্টা দলিল প্রদান করবে।
ক্রমিক নং- ৪৪, গাম্ (অস্থাবর সম্পত্তি) :
গাম্ বলতেসকল প্রকারের অস্থাবর সম্পত্তিকে বুঝাবে। ঐসব সম্পত্তি অথবা দ্রব্যাদি বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্য। রাং, গান্সারীপক, রিকনাকগ্, দানিল, মিল্লাম, ক্রাম প্রভৃতি এবং গৃহের আসবাবপত্র ও চাষাবাদের সরঞ্জামাদি ঐসব সম্পত্তির অন্তর্ভূক্ত।
ঐসব সম্পত্তির উপর মাহারীর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকেনা, কিন্তু উল্লেখিত জিনিসগুলো কেউ যদি বিক্রি করে অথবা কোনভাবে হস্তান্তর করে তাহলে তার সুনামের উপর প্রভাব পড়বে এবং আত্মীয়স্বজন তাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন, কর্তব্যপরাম্মুখ এবং পূর্বপুরুষের স্মৃতিসমূহকে অবজ্ঞাকারী মনে করবে।
ক্রমিক নং- ৪৫, সম্পত্তির শ্রেণী ভাগ :
আগেকার দিনে গারো সমাজে উত্তরাধিকারীসূত্রে প্রাপ্ত এবং অধিকৃত সম্পত্তির মধ্যে কোন পার্থক্য ছিলনা, তবে বর্তমানে আইন আদালতে আশ্রয় গ্রহণের সুবিধাহেতু উক্ত সম্পত্তিসমূহ আলাদা আলাদা করে দেখানো হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিকে গারোরা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে এবং ঐ জাতীয় সম্পত্তি বিক্রয়যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না।
অন্যদিকে নিজের কষ্টার্জিত ভূসম্পত্তি বিক্রয় অথবা অন্য কোন রকম হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও গৃহকর্তাকে গৃহের নক্মা এবং নক্রমের সম্মতি নিতে হবে এবং সে সময় তারা যদি অসম্মতি প্রকাশ করে তবে উক্ত ভূসম্পত্তি বিক্রয় অথবা হস্তান্তর করা যাবে না। এক্ষেত্রে মাহারীর স্মরণাপন্ন হতে হবে এবং তারাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
পুরুষের অধিকার
(ক) কোনরকম সম্পত্তি সরাসরিভাবে পুরুষের অধিকারে থাকবে না, যদিও পুরুষ পরিবারের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে পরিগণিত।
(খ) কোন পুরুষ উত্তরাধিকারীসূত্রে কোন সম্পত্তির অধিকারী হবেনা এবং দানসূত্রে অথবা অন্য কোন উপায়ে যদি কোন সম্পত্তি তার অধিকারে আসে, তবে সে উহা তার নামে রাখতে পারবেনা, কিন্তু সে উহা তার মা অথবা স্ত্রীর কাছে জমা দিবে।
(গ) কোন পুরুষ কাউকে দান অথবা অন্য কোন উপায়ে কোন সম্পত্তি দিতে পারেনা, যেহেতু সত্যিকার অর্থে সে কোন সম্পত্তির অধিকারী নহে।
(ঘ) কোন পুরুষ নিজের কাছে কোন টাকাকড়ি রাখতে পারে না। তবে কোথাও যাবার জন্য যাত্রা খরচ বাবদ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে প্রয়োজনীয় টাকাকড়ি সে নিজের কাছে রাখতে পারে।
ক্রমিক নং- ৪৬, পান্থে গিতা (অবিবাহিত যুবক হিসাবে) :
অবিবাহিত অবস্থায় মাতৃগৃহে থাকাকালে ছেলে যা কিছু উপার্জন করে তা মায়ের অধিকারেই থাকবে। এক্ষেত্রে ছেলে মাতৃগৃহে থাকুক অথবা নাই থাকুক তার উপার্জনের সমুদয় টাকাকড়ি মায়ের সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। ছেলে যখন কর্মক্ষম হয়ে উঠে তখন তাকে কিছু পরিমাণ জমি আলাদাভাবে চাষাবাদ করার জন্য দেয়ার প্রথা গারো সমাজে বিদ্যমান।
গারোরা সেটিকে আতত্ বলে। পরিবারের অন্যান্য কাজকর্ম নিয়মিত করার ফাঁকে ফাঁকে গারো ছেলেরা সেই জমিতে নিজের পছন্দানুযায়ী চাষাবাদ করে ফসল উৎপন্ন করে এবং উৎপন্ন ফসলের বিক্রয়লব্ধ অর্থে তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিসপত্র যেমন-তেল, সাবান, বই, পুস্তক প্রভৃতি নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রাদি ক্রয় করে। এতে স্পষ্টত:ই বুঝা যায় যে, ঐ রকম ব্যক্তিগত ছোটখাটো জিনিসপত্র কেনার ব্যাপারে স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যেই গারো পিতামাতা বয়ো:প্রাপ্ত ছেলেদের আতত্ দিয়ে থাকে। কোন কোন সময় গারো ছেলেরা অন্যের বাড়ীতে এমনকি অন্য গ্রামেও চুক্তিতে কাজ করে থাকে।
ঐ কাজ দু’রকমের হতে পারে যথাঃ
(ক) চাকর হিসাবে, গারো ভাষায় যাকে চাক্কল বলা হয় এবং
(খ) গোলাম হিসাবে, গারো ভাষায় যাকে নক্কল বলা হয়। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে ছেলে তার কাজ বাবদ নির্দিষ্ট বেতন পাবে। সে থেকে নিজের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রাদি কেনার জন্য কিছু পরিমাণ টাকা নিজের কাছে রেখে বাকী সবটুকু টাকা তার মাকে দিয়ে দেবে।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ নক্কলের ক্ষেত্রে ছেলে তার বেতনের সমুদয় টাকা তার মাকে দিয়ে দেবে অর্থাৎ কোন দেনা পরিশোধের জন্যই সে নির্দিষ্ট সময় অন্যের বাড়ীতে গোলামী খাট্বে। সাবালক ছেলে সম্ভব হলে তার কায়িক পরিশ্রমের টাকায় গরু বাছুরও কিনতে পারে।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো পরিবারের সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হয়ে যাবে। ছেলে যদি নিজের বাড়ীতে বসবাস না করে কোন নিকটাত্মীয় যেমন-বোন, মাসী প্রভৃতির বাড়ীতে বসবাস করে তবে তারা উক্ত ছেলের উপার্জিত অর্থসম্পদ ভোগ করতে পারবে। কিন্তু অন্য মাহারীর বাড়ীতে বসবাস করলে সেই মাহারীর লোকজন কোনক্রমেই তা ভোগ করতে পারবে না।
ছেলে অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেলে অথবা অন্যত্র পলায়ন করলে তার সম্পত্তি তার মায়ের অধিকারে চলে যাবে। অবশ্য ছেলের অসুখ বিসুখের সময় তার চিকিৎসা, ঔষধপত্র এবং পূজা-পার্বনের সমস্ত ব্যয়ভার মা বহন করবেন। ছেলের অবিবাহিত অবস্থায় মা মারা গেলেও প্রধানত: সৎ মা এবং মাহারীর তত্ত্বাবধানেই ছেলেরা থাকে। বর্তমানে অবশ্য এর কিছু কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
বিশেষ করে মায়ের মৃত্যুর পর ছেলে যদি অন্য কারোর বাড়ীতে গিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করে, তবে তার উপর সৎ মায়ের অধিকার অনেকটাই কমে যায়। অতএব, দেখা যায় সামাজিক এইসব নিয়ম-কানুনের ফলেই ছেলেরা কোন সময় মায়ের অবাধ্য হতে পারে না। কারণ সবসময়ই আত্মীয়স্বজন অর্থাৎ মাহারীর লোকজন মায়ের স্বপক্ষে থাকবে এবং মাহারীর সিদ্ধান্ত বর্তমানকালেও সর্বজনগ্রাহ্য।
ক্রমিক নং- ৪৭, চাওয়ারী গিতা (জামাতা হিসাবে) :
বিয়ের দিন ছেলে তার আতত্ হতে উপার্জিত যৎসামান্য নিজস্ব টাকাকড়ি এবং কাপড়-চোপড় নিয়ে শ্বশুরবাড়ীতে চলে যাবে। এর অতিরিক্ত সে কিছুই দাবী করতে পারে না অথবা নিয়ে যেতে পারে না, এমনকি পিতৃ-মাতৃ গৃহে অবস্থানকালে সে যদিও বিস্তর পরিমাণে রোজগার করেও থাকে। বিয়ের সময় মা-বাবা ইচ্ছে করলে স্বাভাবিক স্নেহবশত: ছেলেকে উপঢৌকনস্বরূপ সামান্য কিছু দিয়ে থাকে। বিয়ের দিন ছেলেটি যা কিছু তার সঙ্গে নিয়ে যায় সেসব নতুন সংসারের সম্পদ হয়ে যায় এবং স্ত্রীর অধিকারে চলে যায়। কোন কোন সময় নতুন সংসারে অভাব এবং অসুবিধা দূর করার অভিপ্রায়ে ছেলের মা-বাবা তাদের জমিজমার কিছু অংশ ছেলে এবং বৌকে ধার হিসাবে দিতে পারে। কিন্তু মা-বাবার সম্মতি ব্যতিত ছেলে কোনক্রমেই কোন কিছু গ্রহণ করতে পারে না। এই ধার নেয়ার ব্যাপারে ছেলে পরবর্তীকালে তার মাকে অথবা তার অবর্তমানে নক্নাকে অর্থাৎ পরিবারের উত্তরাধিকারিনী হিসাবে নির্বাচিতা বোনকে পরিশোধ করে দিতে বাধ্য থাকবে। আর ছেলের অবর্তমানে অথবা তার মৃত্যুরপরে তার স্ত্রী অথবা বংশানুক্রমে তার মাহারীর লোকেরা উক্ত ঋণের দায়ে থাকবে।
ক্রমিক নং- ৪৮, মিয়াপা গিতা (স্বামী অথবা পিতা হিসাবে) :
সারাজীবন স্বামী যা কিছু উপার্জন করে তার সবকিছুই স্ত্রীর অধিকারে থাকবে। কাজেই পুরুষ মূখ্যত: পরিবারের তত্ত্বাবধায়কস্বরূপেই পরিগণিত থাকে। পারিবারিক প্রয়োজনে উত্তরাধিকারীসূত্রে প্রাপ্ত কোন মূলধন ব্যবহার করতে হলে স্বামী তার স্ত্রী, পরিবারের নক্না, নক্রম এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে মাহারীর সম্মতি নিবে।
অবশ্য বর্তমানে পারিবারিক উন্নতিকল্পে কোন সৎকাজে স্বামী তার সংসারের মূলধন নিজের ইচ্ছানুসারে ব্যবহার করতে পারেন। এক কথায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে স্বামী সংসার পরিচালনায় তার ইচ্ছানুযায়ী সম্পদের ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু যখনই সংসার পরিচালনায় তার অযোগ্যতা প্রকাশ পাবে তখনই মাহারীর লোকেরা তার কাজে হস্তক্ষেপ করবে।
ক্রমিক নং- ৪৯, নক্রম গিতা (পরিবারের উত্তরাধিকারিনী মেয়ের স্বামী হিসাবে) :
বিয়ের দিন নক্রম তার সঙ্গে যে সব জিনিসপত্রাদি তার মায়ের বাড়ী হতে আনয়ন করে তৎসমুদয় সে তার শ্বাশুড়ীর নিকট হস্তান্তর করবে এবং শ্বাশুড়ীই আজীবন পরিবারের কর্ত্রী হিসাবে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তার মৃত্যুর পর সেগুলোসহ সংসারের যাবতীয় পারিবারিক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নক্নার উপর অর্থাৎ নক্রমের স্ত্রীর উপর বর্তাবে। এভাবে শ্বশুরও আজীবন পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে।
ক্রমিক নং- ৫০, ওয়াংগিপা পিতা (সৎ পিতা হিসাবে) :
কোন পুরুষ যখন কোন বিধবাকে বিয়ে করে তখন সে স্বাভাবিকভাবেই উক্ত পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে গণ্য হয়ে যায়। অবশ্য সে উহার বেশী কিছু দাবী করতে পারেনা এবং পরিবারের উন্নয়নমূলক কোন কাজে পরিবারের সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাহারীর অনুমোদন গ্রহণ করা তার অবশ্য কর্তব্য।
ক্রমিক নং- ৫১, জিক্ সিআংগিমিন (বিপত্মীক হিসাবে) :
বিপত্মীক ব্যক্তিকে পূনরায় স্ত্রী প্রদান না করা পর্যন্ত সে ঐ বাড়ীতেই থাকবে এবং মাহারীর নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে সংসার পরিচালনা করবে। যদি কোন কারণবশত: সে দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ না করে তবে পারিবারিক সম্পত্তি তত্ত্বাবধানের অধিকার পরিবারের নক্রমের হাতে ন্যস্ত হয়ে যাবে।
অন্যদিকে উক্ত বিপত্মীক তার মৃতা স্ত্রীর মাহারীর বাইরে অন্য কাউকে যদি বিয়ে করে, তবে সে ঐ পরিবারের কোন কিছু না নিয়ে ঐ গৃহ পরিত্যাগে বাধ্য হবে এবং আখিম্ আইন ভঙ্গের অভিযোগে তার প্রথম স্ত্রীর মাহারীকে ৩,০০০.০০(তিন হাজার) টাকা অর্থদন্ড প্রদানে বাধ্য থাকবে।
ক্রমিক নং- ৫২, জিক্ সে-ওয়াত্ গ্রিক্গিপা (বিবাহ বিচ্ছেদ প্রাপ্ত পুরুষ) :
পারস্পরিক সম্মতিক্রমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে থাকলে পুরুষ ঐ পরিবারের কোন কিছু গ্রহণ না করে গৃহত্যাগ করবে। স্ত্রীর দোষে যদি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে থাকে এবং সে যদি উত্তরাধিকারিনীর অধিকারচ্যূতা হয় তবে যেসব ছেলে মেয়ে তার সঙ্গে যেতে চাইবে সেইসব ছেলেমেয়েসহ স্ত্রী গৃহত্যাগ করবে।
বাকী ছেলে মেয়েরা বাড়ীতে তাদের পিতার সঙ্গে থেকে যাবে এবং পরিবারের সম্পত্তি সাময়িকভাবে পুরুষের অধিকারেই থাকবে। এক্ষেত্রে গৃহত্যাগিনী স্ত্রীর মাহারীর লোকজন যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি মাহারী হতে তার জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
দোষী স্ত্রীলোকটিকে মাহারীর লোকজন যদি তাড়িয়ে না দেয় এবং পুরুষটি যদি সংশ্লিষ্ট মাহারী হতে অন্য কাউকে পুন:র্বিবাহ করতে রাজী না হলে তবে সে ঐ পরিবার এবং গৃহ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সে আখিম্ আইন ভঙ্গের দায়ে পড়বে না এবং অর্থদন্ড প্রদানও করতে হবে না। উপরন্তু উক্ত গৃহ পরিত্যাগ করে চলে যাবার পর সে তার পছন্দানুযায়ী অন্য যে কাউকে বিয়ে করতে পারবে।
ক্রমিক নং- ৫৩, কাথাংগিপা-গিতা (পলাতক হিসাবে) :
কেউ যদি স্ত্রীকে পরিত্যাগপূর্বক পলায়ন করে তবে সে উক্ত স্ত্রীর সংসার হতে কিছুই নিয়ে যেতে পারবে না। যদি কোন কিছু নিয়েও যায় তবে সে উহা ফেরতদানে বাধ্য থাকবে। আর ফেরতদানের আগেই সে যদি মারা গিয়ে থাকে তবে তার মাহারীর আত্মীয়স্বজনরা উহা ফেরতদানে বাধ্য থাকবে।
পুরুষের পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায় না। অতএব অন্যত্র গিয়ে যা কিছু সে উপার্জন করে উহা তার পরিত্যক্ত স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে পাঠাতে বাধ্য থাকবে। আর সে যদি ওখানে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে তবে আখিম্ আইন ভঙ্গের অভিযোগে তার পরিত্যক্ত স্ত্রীকে ৩,০০০.০০(তিন হাজার) টাকা জরিমানা প্রদানে বাধ্য থাকবে, সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহের পূর্বদিন পর্যন্ত তার উপার্জিত সমস্ত টাকাকড়ি তার প্রথম স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরকে প্রদানে বাধ্য থাকবে।
দত্তক গ্রহণ
ক্রমিক নং- ৫৪, আত্মীয়দের মধ্য হতে দত্তক গ্রহণ :
কোন দম্পতির যখন কোন মেয়ে সন্তান থাকে না অথবা মেয়ে সন্তান থাকলেও সেটি নক্না নির্বাচনের উপযোগি নয়, তখন সেই দম্পতি তাদের নিকটতম আত্মীয়দের নিকট হতে দত্তক গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে আপন বোনের কন্যা সন্তানকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও করা চলে।
ক্রমিক নং- ৫৫, অন্য মাহারী হতে দত্তক গ্রহণ :
দত্তক গ্রহণেচ্ছুক মা যদি আপন আত্মীয় বা নিজ মাহারীর মধ্য হতে দত্তক গ্রহণ উপযোগি কন্যা সন্তান না পান, তাহলে ইচ্ছা করলে তিনি অন্য মাহারী হতেও দত্তক গ্রহণ করতে পারেন।
ক্রমিক নং- ৫৬, অজ্ঞাত পরিচয় পিতামাতা হতে দত্তক গ্রহণ :
হাসপাতাল অথবা শিশু সদন হতে নবজাতক শিশু কন্যাকে দত্তক গ্রহণ করার বিধানও গারো সমাজে বিদ্যমান।
ক্রমিক নং- ৫৭, দত্তক পুত্র-কন্যাদের সামাজিক অধিকার :
দত্তক পুত্র-কন্যাগণ মা-বাবার প্রকৃত সন্তানের মতই পারিবারিক এবং সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে থাকে। সেই সঙ্গে তারা পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারীত্বও লাভ করে অথবা অন্যায় অপরাধের জন্য উত্তরাধিকারীত্বের অধিকার হারায়।
ক্রমিক নং- ৫৮, ভাবী আকিং নক্মা হিসাবে নির্বাচনযোগ্য ছেলে দত্তক গ্রহণ :
কোন অপুত্রক আকিং নক্মা এবং তার স্ত্রী যখন তাদের উত্তরাধিকারী হিসাবে কাউকে দত্তক গ্রহণ করতে চান সেক্ষেত্রে ঐ আকিং নক্মা দম্পতির প্রাথমিক দায়িত্ব হবে সঠিকভাবে যাচাই করে দেখা এবং নক্মার স্ত্রীর মাহারীর লোকজনের মতামত গ্রহণ করা যাতে ভবিষ্যতে কোনরকম প্রশ্ন না আসে এবং দত্তক গ্রহণের বৈধ্যতায় চ্যালেঞ্জ না আসে।