গারোদের সমাজ এর মধ্যে প্রধান দুটি গোত্র বা মাহারি রয়েছে; সাংমা এবং মারাক।
সকলেই নিজ নিজ গোত্রকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। তাই এই বৈজ্ঞানিক, আধুনিকতার যুগেও নিজেদের গোত্রকে, রক্তের সম্পর্ককে, বংশ মর্যাদাকে, জাতীয় মূল্যবোধকে রক্ষা করে চলেছে বংশপরম্পরায়; আপন মহিমায়।
জাতীয় মূল্যবোধ, স্বগোত্রের টান এমনই, একজন সাংমা বা চিরান পৃথিবীর যে প্রান্তের সাংমা বা চিরান হোক না কেন, গোত্র বা মাহারি জানা মাত্র ঘনিষ্ট আত্মীয় বা আপন ভাইবোনের মত সম্পর্ক মনে করে। যুগপযুগ ধরে গারো সমাজ পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সেভাবেই সবাইকে শিক্ষা দিয়ে এসেছে, আন্তরিকতার সাথে, শ্রদ্ধার সাথে মেনে এসেছে এবং তা এখনও কালচার করে চলেছে।
গারোদের প্রত্যেকটি পরিবারের বাবা-মা তাদের শিশুর জ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে মানুষের পরস্পরের সম্পর্ক এবং সম্বোধনের বিষয়গুলো শিখিয়ে দেন। একারনে পাঁচ সেকেণ্ডের বড়কেও কেউ নাম ধরে ডাকে না। পরিবার থেকে বাবা-মা যেভাবে রক্তের সম্পর্ক, পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্কের হিসাবটি শিখিয়েছেন অর্থাৎ পারিবারিক সম্পর্ক হিসেবে কাকে, কখন কিভাবে সম্বোধন করতে হয় ইত্যাদি। গারোরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের গৃহের সন্তানদের সেভাবেই শেখানো হয়ে থাকে।
গারোদের সমাজ সম্পর্ক এবং সম্বোধন নিম্নরূপে প্রচলিত রয়েছে, যেমন
১) স্বগোত্র/মাহারির সম্পর্কগুলো হবে- মা, মামা, মাসি (খালা), জ্যেঠি (মায়ের বড় বোন), বড়ভাই, ছোটভাই, বড়বোন, ছোটবোন, ভাগ্নে, ভাগ্নী, শ্বশুর, তাওই ইত্যাদি।
২) বিপরিত গোত্র/মাহারির সম্বোধনগুলো হবে- বাবা, কাকা, মেসো (খালু) জ্যেঠা, শাশুড়ি, মামী, মাওই ইত্যাদি।
৩) গারোদের মধ্যে শুধুমাত্র মামাত ভাইবোনকে বিয়ে করা যায়। সে হিসাব অনুযায়ী মামা, শ্বশুর, ফুফা এবং তাওই সকলেই মামা সম্পর্কের।
৪) কাকা, মেসো, জ্যেঠাত ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে করা যায় না।
৫) স্ত্রীর মামা, তাওই এবং ফুফার ছেলেমেয়েদেরকে আমার ভাইবোনেরা বিয়ে করতে পারবে না। এরা সম্পর্কে আপন ভাইবোনের সমতুল্য হয়ে যাবে।
৬) কোন সাংমা বা মারাক ছেলেমেয়ে তার স্বগোষ্ঠী/মাহারির কোন পুরুষকে বা পিতার সমবয়সী কাউকে বাবা, কাকা, মেসো (খালু), জ্যাঠা বলে সম্বোধন করবে না। তাঁরা সকলেই মামা সম্পর্কের হবেন। এমনকি স্ত্রী বা স্বামীর পিতাকেও মামাই ডাকা হয়; বাবা/আব্বা সম্বোধন প্রচলিত নয়। (বাঙালি বা হিন্দু সমাজের মতো শ্বশুরকে বাবা/আব্বা ডাকার নিয়ম নেই গারো সমাজে। যদিও আধুনিকালে অনেকেই শ্বশুর শাশুড়িকে বাবা-মা ডাকা শুরু করেছেন।)
৭) কোন সাংমা বা মারাক ছেলেমেয়ে তার অপরগোষ্ঠী/মাহারির কোন মহিলাকে বা মায়ের সমবয়সী কাউকে মা, মাসী, কাকী (খালা), জ্যাঠিমা বলে সম্বোধন করবে না। উনারা হবেন মামী, ফুফু, মাওইমা ইত্যাদি।
৮) সাংমা-মারাক উভয় গোত্রেই কয়েকটি কমন সম্বোধন রয়েছে যেমন-
৮.১ আচ্চু-আম্বি – বাঙালি মুসলিম সমাজে বাবা বাবা-মাকে দাদু-দাদি এবং মায়ের বাবা-মাকে নানা-নানি সম্বোধন করতে দেখা যায়। কিন্তু গারো সমাজে বাবা এবং মা উভয়ের বাবা-মাকে আচ্চু এবং আম্বি সম্বোধন করা হয়। অর্থাৎ নানা-দাদা উভয়কেই আচ্চু এবং নানি-দাদি উভয়কেই আম্বি সম্বোধন করা হয়।
৮.২ পুত্র-কন্যা – যেহেতু সাংমা গোত্রের পিতা মারাক গোত্রের মাকে বিয়ে করে। সেহেতু, পিতার বিপরিত গোত্র এবং মায়ের স্বগোত্রে পুত্র ও কন্যা; উভয়েরই পুত্র-কন্যা বলে পরিগণিত হয়। তেমনই পুত্র-কন্যার সন্তানেরা উভয় গোত্রেরই নাতি-নাতনী, পুতি-পুত্নীদের বেলায় প্রযোজ্য।
৯.৩ বেয়াই-বেয়াইন- মারাক গোত্রের মামী এবং মাওইদের পুত্র-কন্যারা অর্থাৎ বেয়াই-বেয়াইনরা মারাক হবেন, এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু ঐ মারাক বেয়াই-বেয়াইনরা সাংমাদের বিবাহ করবেন, তখন তাদের স্বামী-স্ত্রীদেরকেও বেয়াই-বেয়াইন সম্বোধন করা হয়। অর্থাৎ উভয় গোত্রেই বেয়াই-বেয়াইন সম্বোধন থাকে।
গারো ভাষায় কাকে এবং কিভাবে সম্বোধন করা হয়, তা নিম্নে দেওয়া হলো–
১) আপফা/ফা (Father) – বাবা/পিতা এবং সৎপিতাকে আপফা সম্বোধন করা হয়। অনেকসময় অতিসম্মানিত ব্যক্তিকেও আপফা বা ফা বলে সম্বোধন করা হয়।
২) আমা/মা (Mother) – মা/মাতা; সৎমাতাকেও আমা সম্বোধন করা হয়
৩) আদা (Elder Brother) – আপন বড় ভাই বা দাদা; বয়সে বড়ভাই সম্পর্কের সকলেই আমার আদা হবেন। সেসাথে কাকা, জ্যাঠা এবং মাসীর ছেলেরা আমার থেকে যারা বয়সে বড় এবং তার বন্ধু সকলেই আমার আদা/দাদা।
৪) জং/জজং (Younger Brother)- আমার বয়সে ছোট; অর্থাৎ ছোটভাই এবং তার বন্ধু সকলেই জং/জজং। আংজং- আংনি জং।
৫) আবি (Elder Sister)- আমার বয়সে বড়বোন এবং তার বান্ধবী সকলেই আবি। অপরিচিতা বয়সে অল্পকিছু বড় মনে হলেও তাকে আবি ডাকা হয়।
৬)নো/নোনো/নু (Younger Sister)- ছোটবোন এবং তার বান্ধবী সবাইকে নো বা নোনো ডাকা হয়। অপরিচিতা বয়সে ছোট মনে হলে নোনো ডাকা যায়। আংনি নো/নোনো- আনো/আনু। অনেক মায়েরা নিজের কন্যাকে আনু/আনো বলে ডাকেন, যদিও নিজের মেয়েকে আনু/আনো সম্বোধনটা সঠিক নয়।
৭) আচ্চু/আৎচু (Grand Father)- নানা ও দাদু অর্থাৎ বাবা-মা উভয়ের বাবা এবং তাদের ভাই, ভায়রা, বেয়াই ও গুরুজন সবাইকে আচ্চু সম্বোধন করা হবে
৮) আম্বি (Grand Mother) – নানি/দাদি এবং তাদের বোন, বেয়ান সম্পর্কের সবাইকে আম্বি সম্বোধন করা হয়
৯) জিক (Wife) – বৌ, স্ত্রী
১০) সে (Husband) – স্বামী
১১) ফাজং (Uncle, Father’s elder brother) – জ্যাঠা বা বাবার বড়ভাই এবং মায়ের বড়বোনের স্বামীকে ফাজং সম্বোধন করা হয়।
১২) আজং (Aunty, Mother’s sister, Wife of father’s elder brother) – জ্যাঠি/জ্যাঠিমা, মায়ের বড়বোন, বাবার বড়ভাইয়ের স্ত্রী। মা এবং মাসীর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বোন।
১৩) আওয়াং (Uncle) – কাকা, চাচা, মেসো।
১৪) আদি (Aunt) – মাসি, কাকী, খালা; তবে মায়ের চেয়ে বয়সে বড় হলে মাসী হবে না, তখন আজং হবে।
১৫) মামা-১ (Maternal Uncle) – মামা; মায়ের বড়ভাই এবং ছোটভাই এবং তাদের ভাই সম্পর্কের সকলেই। তবে মায়ের মামাত/ফুপাতো ভায়েরা মামা হবেন না।
১৬) আনি/মানি-১ (Maternal aunt) – মামি, মায়ের ভাই সম্পর্কের স্ত্রী।
১৭) মামা ২ (Uncle, Father’s sister in law)- ফুপা, পিসা, বাবার বড় বোন এবং ছোটবোনের স্বামী।
১৮) আনি/মামি-২ (Aunty, Father’s sister)- ফুপু, পিসি, বাবার বড়বোন এবং ছোটবোন।
১৯) গ্রি/আংগ্রি (Nephew) – ভাগ্নে; কাকাত,জ্যেঠাত বোনের ছেলে
২০) নাম্চিক (Niece) – ভাগ্নি, কাকাত এবং জ্যেঠাত বোনের মেয়ে।
২১) উবুদি (Father in law) – শ্বশুর; স্বামী এবং স্ত্রীর পিতা।
২২) মানি/আনি (Mother in law) – শাশুড়ি; স্বামী এবং স্ত্রী মাতা।
২৩) চাওয়ারি (Son in law) – জামাতা, মেয়ের স্বামী।
২৪) নামচিক/দেনি জিক (Daughter in law) – পুত্রবধু, বৌমা।
২৫) গুমি (Brother in law) – দুলাভাই, জামাইবাবু, বড়বোনের স্বামী।
২৬) বুজি (Sister in law) – বৌদি, ভাবি, বড় ভাইয়ের স্ত্রী।
২৭) সারি (Elder Sister in law) – বড় ননদ, স্বামীর বড়বোন, স্ত্রীর বড় বোন, জ্যেঠাস।
২৮) নোসারি (Sister in law) – ছোট ননদ, শ্যালিকা, স্বামীর ছোটবোন; স্ত্রীর ছোটবোন।
২৯) বোনিং (Brother in law) – স্ত্রীর বড়ভাই, সমুন্ধি, ছোটবোনের স্বামী, মামাত ভাই, শ্যালক।
৩০) জংসারি (Brother in law) – শ্যালক, মামাত ভাই।
৩১) সু./সু.উ (Grand Son/Daughter) – নাতি, নাতনি, নাতবৌ, নাতজামাই।
৩২) দে/দে.ফান্তে (Son) – পুত্র
৩৩) দেমে.চিক (Daughter) – কন্যা।
৩৪) মসা (Wife’s maternal uncle) – স্ত্রীর মামা, ভাগ্নীর স্বামী। কেউ কেউ মামাতো ভাই অথবা অপরিচিত সমবয়সী ছেলেরা পরস্পরকে মসা সম্বোধন করে থাকে।
৩৫) সাদু/সাতু (Husbands of Sisters in law) – ভায়রা।
গারো জাতির মূল্যবোধ ও বৈশিষ্ট্যগুলো খুবই সাদামাঠা হলেও গারোরা নিজেদের জাতিসত্ত্বাকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অন্যান্য জাতির চাইতে অনেক বেশি অগ্রগামী।
গারোদের মধ্যে প্রধান ১৩টি গোত্র বা সম্প্রদায় (উপগোত্র-১৭টি) থাকা সত্ত্বেও সকলেই গারো জাতিসত্ত্বাকে শ্রদ্ধা করে। মাহারি বা মাচং-এর প্রতি একাত্ববোধ একটি অনন্য উদাহারন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক গারো আরেক গারোর সাথে পৃথিবীর যে প্রান্তেই দেখা হোক না কেন, তাদের প্রথম কাজ হবে মাহারি বা মাচং জানা।
এভাবে গারোরা আত্মীয়তার সন্ধান করতে থাকে। পরবর্তীতে সে আত্মীয় এমনকি আপন আত্মীয় হয়ে যায় এবং উপরোক্ত যে কোন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এভাবেই মা-মানকদের প্রতি সম্মান, চ্রা এবং জিকচলদের প্রতি সম্মান প্রদান করে থাকে। অন্যান্য জাতির মতো গারোদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব দেখা যায় না।
এভাবেই গারোরা এখন পর্যন্ত গারো সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে, সমাজকে এগিয়ে নিতে দায়িত্বশীলতার প্রমাণ রেখে এসেছে।