প্রাচীন গারো সমাজে বহু আচার বা বিধি-নিষেধ বা গারোদের লোক বিশ্বাস এর সন্ধান পাওয়া যায়। এই বৈজ্ঞানিক যুগেও মুরব্বীদের মুখে এমন বিধি-নিষেধের কথা বলতে শোনা যায়।
এসব প্রচলিত বিধি নিষেধের বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা নেই বলে আধুনিক যুগের ছেলে-মেয়েরা অনেকেই কুসংস্কার মনে করলেও প্রাচীন গারোরা এখনও এসব মেনে চলেন এবং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের অমঙ্গল আশঙ্কায় প্রজন্মদেরকেও মেনে চলার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
নিম্নে আচার বা বিধি-নিষেধ বা গারোদের লোক বিশ্বাস এর নমুনা সংক্ষেপে দেওয়া হলো-
- ডান চোখের পাতা কাঁপলে কেউ মারা যাবে।
- বাম চোখের পাতা কাঁপলে কেউ মারা যাবে।
- গভীর রাতে ডাহুক ডাকলে অমঙ্গল বা কারোর মৃত্যুর সম্ভাবনা।
- রাতে বা অসময়ে কুকুর কুঁইকুঁই করে বা অস্বাভাবিকভাবে ডাকলে অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকে।
- ভোরে কাক ডাকলেও অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকে।
- যাত্রার প্রাক্কালে হাঁচি দিতে নেই, বিপদ বা অমঙ্গলের লক্ষণ।
- যাত্রার সময় কালি কলসী দেখতে বা দেখাতে নেই, অমঙ্গলের লক্ষণ।
- যাত্রার সময় বন্য কোন পশু যেমন- শেয়াল, বেজি, বনবেড়াল, সাপ ইত্যাদি বাদিকথেকে ডানদিকে পেরোলে যাত্রা শুভ; আর যদি ডানদিকথেকে বাঁদিকে যায় তবে অশুভ লক্ষণ।
- দুটি মোরগ বা মুরগী ঝগড়া করলে ঘরে অতিথি আসবে।
- বিড়াল নিজের গা চাটলে বা পরিস্কার করলে ঘরে অতিথি আসার সম্ভাবনা।
- হাতথেকে বাসন কোসন, হাঁড়িপাতিল ফসকে পড়ে গেলে বাড়তি খাওয়ার মতো লোক বা অতিথি আসবে।
- ডানহাত চুলকালে অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা।
- বামহাত চুলকালে অর্থ ক্ষতির সম্ভাবনা।
- বারবার নিজের জিহ্বায় কামড় লাগলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা।
- বিষম খেলে বা কেউ স্মরণ করছে বুঝায়।
- হঠাত কানে শমশম শব্দ হলে কেউ কোন সংবাদ দিবে বা কেউ গালি দিচ্ছে মনে করা হয়।
- কোন ব্যক্তির বা পরিবারের অমঙ্গল কামনা বা অভিশাপ দিতে নেই, তাতে নিজেরই অমঙ্গল হয়।
- সালিশ বৈঠকে পা সামনের দিকে মেলে বা ছড়িয়ে বসতে নেই, সালিশ মিটানো যায় না বা সসমাধান হয় না।
- রাতের বেলা ফল এবং পাতা ছিঁড়তে নেই, গাছেরা কাঁদে, অভিমান করতে পারে।
- গাছের গোড়ায় মলমুত্র ত্যাগ করতে নেই, মনের কষ্টে গাছ মরে যায়।
- সন্ধায় এবং রাতে গাছের নীচে মলমুত্র ত্যাগ করতে নেই গাছেরা অভিশাপ দেয়।
- পাকা ধানের ক্ষেতে মলমুত্র ত্যাগ করতে নেই, লক্ষ্মী পালায়।
- গৃহপালিত পশুপাখিদের উপরে মলমুত্র ত্যাগ করতে নেই, অভিশাপ দেয়।
- ধান বা অন্যান্য শস্যের আইলে দাঁড়িয়ে বা কাছাকাছি শিস দিতে নেই পোকায় আক্রমণ করবে।
- গোবরে থুথু ফেলতে নেই, গলা ব্যাথা হবে।
- ধানের উপর বসতে নেই, প্রয়োজন ব্যতীত পায়ে মাড়াতে এবং দাঁড়াতে নেই, দানালক্ষ্মী কষ্ট পায়।
- কালিসন্ধ্যায় এবং রাতের বেলা শিস দিতে নেই, মন্দ আত্মা বা শয়তান, ভুতপেত্নিরা চল আসতে পারে।
- রাতে মোরগ ডাকলে অমঙ্গলের লক্ষণ।
- রাতে কীটপতঙ্গ মারতে নেই, ঘুমন্ত মানুষের আত্মা কীটপতঙ্গের রূপ ধরে ঘোরাফেরা করে।
- রাতে ভ্রোমর, মৌমাছি, বোলতা, প্রজাপতি ইত্যাদি ঘুমন্ত মানুষের আশেপাশে উড়াউড়ি করলে বা কারোর গায়ে বসলে সেটিকে ধরে আটকে সকাল পর্যন্ত রাখতে হয়। সেগুলো দিয়ে কবিরাজরা বান মারে বা যাদুটোনা করে।
- কালিসন্ধায় ধান ভানতে নেই, চাউলও চাল ঝাড়তে নেই। পরিবারের অমঙ্গল হয়।
- ভাত-তরকারি রান্নার সময় ভাতের চামচ বাঁ কাঠি দিয়ে হারিতে টোকা দিতে নেই, লক্ষ্মী পালায়।
- চাল শেষ হয়ে গেলেও চাল রাখার দিকথম বা পাত্রে কিছু অবশিষ্ট রাখতে হয়, দানালক্ষ্মী কাঁদে, অভাব ঘোচে না।
- আখাম ( পোড়া ভাত) কোন ছেলে বা পুরুষকে দিতে নেই, পুরুষ বেজার হবে, লোকে নিন্দা করবে।
- পান সুপারি খেতে খেতে এবং ধূমপান করতে করতে রান্না করতে নেই।
- পান খেয়ে পানগাছথেকে পান ছিঁড়তে নেই, গাছ মরে যায়।
- রাতের বেলা পান ছিঁড়তে নেই গাছ মরে যায়।
- ঋতু চলাকালীন পান গাছে যেতে নেই, গাছ মরে যায়।
- রাতের বেলা হাঁড়ির তলানির পোড়াভাত সশব্দে বাড়তে নেই, লক্ষ্মী পালায়।
- সন্ধ্যায় ভাজা পোড়া কোন কিছু খেয়ে বাইরে বেরুতে নেই, শয়তান পিছু ধরবে।
- রাতে সরবরাহকৃত খাবার আগুনে হালকা ছেকা দিয়ে খেতে হয়।
- নখ, কাপড়ের টুকরা এবং মহিলাদের চুল যেখানে সেখানে ফেলতে নেই, এগুলো দিয়ে বান মারা যায়।
- ভাত, ধান এবং টাকা-পয়সা যেখানে সেখানে ফেলে রাখতে নেই নেই, অলক্ষ্মীর লক্ষণ।
- সন্ধ্যায় এবং রাতে উঠান ঝাড়ু দিতে নেই, গৃহলক্ষ্মীর ঘরে আগমন এবং বিশ্রামের সময়।
- রাতে রান্নাঘর বা খাবার ঘর ঝাড়ু দিয়ে উচ্ছ্বিষ্ট খাবার বা ময়লা ঘরের বাইরে ফেলতে নেই।
- পিতা, দাদা, নানা শ্রেণীর মুরুব্বীদের বসার নির্ধারিত আসন পিঁড়ি বা চেয়ারে বসতে নেই।
- খাবার সামনে রেখে কান্না করতে এবং অকারণে উচ্চস্বরে হাসতে নেই।
- উত্তরদিকে মাথা রেখে ঘুমাতে নেই, মৃতকে উত্তরদিকে মাথা রেখে শোয়াতে হয়।
- ঘুমানোর সময় বালিশে পা রাখতে নেই, ঘাড় ব্যথা করবে।
- ছাতার উপরে বসতে নেই, অমঙ্গল হবে।
- কাপড়ের সুতা না পুড়ে ব্যবহার করতে নেই, নাহলে ঐ কাপড়ের সুতো নিয়ে কেউ বান মারতে পারে।
- মহিলাদের গাছে উঠতে নেই, গাছ অশুচি হয় এবং মরে যায়।
- ঋতু/মাসিক চলাকালীন কোন মহিলা ফলজ বৃক্ষের কাছে যাবে না, গাছ অশুচি হয়।
- শনিবারে বিবাহ করতে নেই, সংসারে শনি আসতে পারে।
- বিবাহের দিনে হাঁড়িপাতিল বা কোনকিছু ভাঙ্গলে অমঙ্গলের চিহ্ন।
- বিবাহভোজে আনা কোন জীবজন্তু (শূকর, গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি জাতীয়) হঠাত মারা গেলে অমঙ্গলের চিহ্ন।
- একই পরিবারে বিবাহ এবং শ্রাদ্ধ দেওয়ার থাকলে, আগে শ্রাদ্ধের (মি.মাং-গ্রো) কাজটা করে ফেলতে হয়।
- বিবাহের দিনে বরকনের কাউকে বিমর্ষভাব দেখা গেলে সংসারে অমঙ্গল হয়।
- গর্ভাবস্থায় শরীর ঢেকে রাখতে হয় এবং পোষাক, বিছানাপত্র ইত্যাদি নোংড়া রাখতে নেই, শয়তানের ঢুকে পড়তে পারে এবং বসবাস করতে পারে।