অত্যাধুনিক এ বিজ্ঞানের যুগেও অনেক ভারতীয় বনৌষধি এবং তার গুণাগুণের ওপর বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি পেটেন্ট করে নিতে সক্ষম হয়েছে। সে তুলনায় আমরা কোনও তথ্য রাখি নি, যেচে কেউ সংগ্রহ করি নি বা করলেও তা লিপিবদ্ধ করি নি।
আর পৃথিবীর প্রায় সকল আদিবাসীদের মধ্যে প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলসমূহে বসবাস করার কারণে, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে বাধ্য হয়ে বনৌষধির ব্যবহারকে কিঞ্চিত টিকিয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশিদের বনৌষধির ওপর নেতিবাচক ধারণা
আমরা মুখে যতোই বলি, সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলার বাংলাদেশ, তা বোধয় মুখেই; সুখের জন্য আমরা যুগের পর যুগ বিজ্ঞানের উপরই বেশি নির্ভরশীল। এর কারণ হলো আমাদের দেশে প্রাচীন ও লোকায়ত প্রজ্ঞা বা মেধা সম্পর্কে অনীহা, অবজ্ঞা এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আস্থা।
গাছগাছড়ার শিকড়-বাকড়ে অসুখ সারার কথা শুনলেই আমরা মনে করি ওগুলো সবই কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস। ফলে আপনার আমার চারপাশে অনাদরে অবহেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ প্রজাতির গাছ-গাছড়া, লতাপাতার গুণাগুণ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে আমরা মোটেও আগ্রহ দেখাই নি।
এ বিষয় আমাদের কথা হচ্ছিলো গারো কবিরাজ খামাল দীনেশ নকরেক-এর সাথে। উনার বয়স সেঞ্চুরি ছুঁই ছুঁই করছে। যদিও তিনি বয়সের ভারে ন্যুজ; তারপরেও তিনি সংসারের কাজ একাই করেন। কখনোই সকাল ১০/১১টার আগে বাড়ির বাইরে কোনো কাজে বেরোতে পারেন না।
কারণ, প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিতে উনার বাড়িতে রোগীরা ভীড় করেন। তিনি জানালেন, একসময় ধনবাড়ি উপজেলা সদরেও ১২ বছর হেকিমী চিকিৎসালয় পরিচালনা করেছেন।
এই পোষ্টে গারোদের আদি চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে পারবেন ।
গারো কবিরাজ খামাল দীনেশ নকরেক
কবিরাজ খামাল দীনেশ নকরেক-এর বিভিন্ন গ্রামে এখনও দুয়েকজন কবিরাজ পাওয়া যায়। তাঁদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেলো- আগে বিভিন্ন ধরণের জ্বর, মাথাব্যথা, সর্দি, কাশি, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, বসন্ত, হাম, পেটের পীড়া, বুকে ব্যথা, ডাইরিয়া, কলেরা, জণ্ডিস, কালাজ্বর, কেটে যাওয়া, ঘা, শরীর চুলকানি, হাত পা ফোলা, শরীর ফোলা, চক্ষুরোগ, পুরুষ ও মহিলাদের যৌনরোগ, সন্তান ধারণে সমস্যা, শিশু জন্মকালীন জটিলতা, হাড় মচকানো, হাড়ভাঙ্গা, গিরায় ব্যথা, শিরায় ব্যথা এবং যক্ষাসহ প্রায় শতাধিক রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীরা আসতেন।
এখন অনেকেই ডাক্তারি চিকিৎসার জন্যে চলে যান, আবার সেখানে ভালো না হলে, আবার উনাদের কাছেই ফিরে আসেন। কবিরাজ খামাল দীনেশ নকরেক বিভিন্ন রোগের ঔষধে ব্যবহার করেন।
এমন ২৫ প্রকারের সঠির নাম জানেন এবং বর্তমানে উনার হেফাজতে প্রায় ২৫/৩০ প্রকারের সঠি রয়েছে। আর বাকীগুলো হারিয়ে গেছে বা পচে গেছে বলে তিনি জানান। সঠিগুলোর নাম সবই গারো ভাষায়, তিনি এগুলোর বাংলা নাম জানেন না, বা বাংলায় নাম মনে রাখার প্রয়োজনও মনে করেন না।
সঠিগুলোর নাম জানালেন
১) দিগগি গিসিম, ২) দিগগি সামজক, ৩) দিগগি সামফাং, ৪) দিগগি জাজক, ৫) দিগগি গিচ্চাক, ৬) দিগগি সামসুম্মুল, ৭) দিগগি আরং, ৮) দিগগি সিংরিম, ৯) দিগগি সামরিম, ১০) দিগগি ওয়ারিং, ১১) দিগগি ওয়াফাং, ১২) দিগগি মাতচা, ১৩) দিগগি মাকবুল, ১৪) দিগগি চিপফু, ১৫) দিগগি পহরি, ১৬) দিগগি ওয়াদাং, ১৭) দিগগি ওয়াল, ১৮) দিগগি জাজিম, ১৯) দিগগি জলসি, ২০) দিগগি আংগলি, ২১) দিগগি ফংফ্রেট, ২২) দাগদিগগি, ২৩) দিগগি সামজিম, ২৪) দিগগি সামপাংফিল, ২৫) দিগগি মাচ্ছোকগিসিম। সঙ্গত কারণে সেসব গাছের গুণাগুণ সম্পর্কে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকাই বাঞ্চনীয় ।
প্রবীণ কবিরাজের কাছে
আমরা কয়েকজন প্রবীণ কবিরাজের কাছে তাদের ব্যবহৃত বনৌষধির গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তাঁরা অনেকেই এসব তথ্য জানানোর আপত্তি করেছিলেন। তবে, অনেক অনুরোধের পর প্রায় দেড়শোটি গাছগাছড়া, লতাপাতার গুণের কথা জানালেন। আমরা যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি, তার নিম্নে দেওয়া হলো-
• বানফাং/ গুদ্দক রুগুবা (বনদেও) : মূর্চ্ছা রোগে।
• বালমাবুসু (মনকাঁটা) : এর ফল এবং শিকড় দুটোই বিষ তৈরীর কাজে লাগে। জানি জাক।
• দারিচিক : পেটের ব্যাথা, মহিলাদের রোগ, বাচ্চা দেরিতে হওয়া।
• রক্তচন্দন : পেটের ব্যাথা, মহিলাদের রোগ, বাচ্চা দেরিতে হওয়া।
• সামমিকচিপ (লজ্জাবতী) : একশিরা, কুষ্ঠ, বসন্ত এবং মায়ের স্তন ব্যথাযুক্ত ফুলে যাওয়ায় সামমিকচিপের পাতা এবং শিকড় ব্যবহার করা হয়।
• উদুম (আতপলাশ) : হাড়ের ব্যথায় গাছের শিকড় বাটা, হাত-পা অবশ হলে এর পাতা গরম করে স্যাক দিতে হয়।
• সামরিম : মহিলাদের বাচ্চা না হলে বা বাচ্চা না টিকলে।
• কাচ্ছিক (ধনেপাতা) : শরীরের ব্যথায়।
• মিসি নাচিল (থানকুনি) : পেটের ব্যথা, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, অর্শ, পুরাতন বাত ব্যথা ও চুল ওঠা বন্ধে কার্যকরী।
• বাদরি : মস্তিষ্ক বিকৃতিতে।
• আগেনদ্রাক (পিরিলাগোটা) : চোখের রোগে কার্যকরি।
• দুর্বা: তাফ্রা/তরাইশ। ভয়ে পেয়ে জ্বর হলে, ক্ষতস্থান জোড়া লাগা, রক্তপড়া বন্ধ করতে।
• গা.ইয়া: পেটের ব্যথা, প্যারালাইজড ঠিক করতে।
• লেংড়াবন (চোরাকাটা/উবুতনেংড়া) : নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হাতপা জ্বালাপোড়া, হাতপা অবশ।
• সামগলদাক : মুখের রুচি বাড়াতে, পেটের ব্যাথা, কৃমি
• আতকপাইল্যা : মাথা ব্যথা।
• ওয়াবিজাকবিচু (বাঁশের পাতা) : ঘা শুকাতে, বাচ্চারা মূর্চ্ছা গেলে।
• দামবং (ঢিবির ব্যাঙের ছাতা) : অর্শ, রুচিবর্ধক, কামবর্ধক, আমাশয় ও কোষ্ঠকাঠিন্য, হাড়ের ব্যাথা নিরামক।
• বলনাগিল (গেছো ব্যাঙের ছাতা বা ছত্রাক) : হাতপায়ের আঙ্গুলের চিপায় ঘা (জাগেগ চাআনা), ও কুঁচকির ঘা/পাচড়া, রুচিবর্ধক, শরীর দুর্বলতা, কামবর্ধক, আমাশয় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে।
• সু.মুচেং : পেট ফোলায় এর শিকড় কাজে লাগে। খেতে হয়।
• সামসুয়েং: এর পাতা, মূল ও ছাল মস্তিষ্ক বিকৃতি ও মুর্চ্ছা গেলে।
• নিমফাং (নিমগাছ) : এর কাণ্ড, ডাল, পাতা, শিকড় সবকিছুই উপকারী। শরীর চুলকানি, হাম, গুটি বসন্ত। কফ জমে বুকের ব্যথা, উকুন, পোকামাকড়ের কামড় বা হুল ফোটানোর ব্যথা, খোসপাঁচড়া এবং ডায়াবেটিসের উপকার হয়।
• ফানেট (তুলসী) : ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশিতে ফানেতের পাতা বেশ উপকারী। তুলসী পাতা ছেঁচা রস গা-হাত-পা ব্যথা, মাথা যন্ত্রণা, চোখ-মুখ জ্বালা করা, মুখে বিস্বাদ দূর করে।
• মংমাসাথিপ: পেটের পীড়া, কাটা ঘা জোড়া, রক্তপাত বন্ধে এবং কৃমিনাশক।
• খাম্বিল (আকন্দ) : জণ্ডিস দূর করতে।
• হামফাং মান্দি (ছন/বন) : এর শিকড় মস্তিষ্ক বিকৃতি ও মুর্চ্ছা গেলে।
• স্থেং (শুয়ইরা আলু): মস্তিষ্ক বিকৃতি ও মুর্চ্ছা গেলে এর মাংস কাজে লাগে।
• জিগা (জিগা): জাগেগ চাআনা ফলটি কাজে লাগে।
• আরুমু (ঢেউয়া বা ঢেউফল): কফবর্ধক, কামোদ্দীপক ও ক্ষুধাবর্ধক। ছাল ব্রণের দুষিত পুঁজা বের করে।
• বলদাখাকখি (খাড়াজোড়া): আমাশয়, ধাতুদূর্বলতায় এর ছাল অথবা পাতা সারারাত ভিজিয়ে এর পানি পান করতে হয়।
• বলসিল (পাতাঙ্গি): এর ছাল অথবা শিকড় বাচ্চাদের ব্রেইনের সমস্যায় কাজে লাগে।
• ঘি কাঞ্চন/ঘৃত কুমারী : মাথা ব্যথা, পেটের পীড়া, বলিরেখা, ব্রণ, পায়ে গোড়ালি ফাটা, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় তাড়াতাড়ি।
• নারাং (কমলা): রুচিবর্ধক, বমিভাব, মুখের দুর্গন্ধ, ক্ষয়রোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য।
• জা.ল্লিক রংখেক (গোলমরিচ): গা-হাত-পা ব্যথা, মাথা যন্ত্রণা, চোখ-মুখ জ্বালা, কৃমিনাশক এবং অরুচী দূর করে।
• নাসিন গিচ্চাক (পেঁয়াজ): পায়ের গোড়ালী ফাটা, মাথা ব্যথা, হেঁচকি, খুশকি, চুল পড়া, সর্দি।
• নাসিন দো.খি (রসূন): চর্মরোগ যাদের ঠাণ্ডা, উচ্চ রক্তচাপ, কাশি কিংবা ক্রনিক ব্রংকাইটিস, ডাইরিয়া, বদহজম বা পেটে ব্যথা এবং ব্রন দূর করতে।
• জাল্লিক (মরিচ): বিষব্যথা, মস্তিষ্ক বিকৃতি ও মুর্চ্ছা গেলে এবং বিভিন্ন রোগের ঔষধের সাথে মরিচ কাজে লাগে।
• নারিকল/নায়রল (ডাব): কিডনীর পাথর, মূত্রজনিত অসুখ, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ব্রণের সমস্যা দূর করতে ডাবের পানি দারুণ ভূমিকা রাখে।
• মদু (পেঁপে) : পেটের গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেঁপের বীজের রস খেলে যকৃতের রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং কাঁচা পেঁপে কাটা বা ফুল ছেঁড়ার পর যে সাদা রস শরীরের ক্ষতস্থান ভালো করে। ফুল ও পাতা কৃমিনাশক। রান্নায় মাংস নরম করে। কাঁচা পেঁপে খেলে গর্ভবতীর গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে।
• দারচিনি (দারুচিনি): দ্বারুচিনি বিছানায় প্রস্রাব রোধের জন্য দারুণভাবে কার্যকর।
• তেজপাতা (তেজপাতা): বাতব্যধি, আমবাত, চুলকানি, দাদ, মাড়ির ক্ষত।
• চিরতা: চুলকানি, ক্রিমি, কুষ্ঠ, জ্বালা, সর্দি-কাশিসহ হাঁপানি, গর্ভকালীন বমি, জ্বর-পরবর্তী দুর্বলতা, অ্যালার্জি দূর করতে।
• কালোমেঘ/চিরতা: কালমেঘ কৃমিনাশক, গা-হাত-পা ব্যথা, মাথা যন্ত্রণা, চোখ-মুখ জ্বালা করা, মুখে বিস্বাদ দূর করে।
• পাথরকুচি (পাথরকুচি): পুরনো সর্দি, অতিরিক্ত তৃষ্ণা, শারীরিক দুর্বলতা, মূত্রনালির সংক্রমণ, পেট ফাঁপায়, শিশুদের পেট ব্যথায়, মৃগী রোগীদের পাথরকুচির রস খাওয়ানো হয়। মূত্র পাথর সারিয়ে দিতে সক্ষম পাথরকুচি। এ ছাড়া ব্রণ, ক্ষত ও মাংসপেশী থেঁতলে গেলে, বিষাক্ত পোকায় কামড়ালে এর পাতা দিয়ে সেঁক দিতে হয়।
• আলত (বাসক) : শিশুর সদির্কাশি, হাঁপানি, কফ, শ্বাসকষ্ট, আমবাত ও ব্রণশোথ (ফোঁড়া), উকুন নিধন, কৃমিনাশক, প্রস্রাবে জ্বালা-যন্ত্রনা, দাদ বা চুলকানি, জন্ডিস, পাইরিয়া বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্তপড়া বন্ধ করে।
• আমড়া : ত্বকের লাবন্য, বদহজমে, ঠাণ্ডা কাশি উপশমে উপকারী।
• জবাবিবাল (জবাফুল) : মহিলাদের মাসিক স্রাব, টাইফয়েড।
• নয়নতারা: ক্রিমিনাশক, রক্তশুন্যতা, রক্তস্রাব, সন্ধিবাত এবং বোলতা, ভীমরুল, মৌমাছি, ভোমরা, পিঁপড়ে, কাঠপিঁপড়ে প্রভৃতির হুলের জ্বালায় ও কামড়ে যন্ত্রনানাশক।
• বেংবং জা’সি: শরীরের জ্বালাযন্ত্রনায় মালিশ করতে, বিষ বেদনা এবং পেটের পীড়া।
• অদ/ঝিঙ্গা (ঝিঙ্গা) : ক্রিমিনাশক, ক্ষুধা বর্ধক ও বেদনাশক।
• লটকন : বমিবমিভাব দূর করতে।
• মেন্দু (অড়হর): জণ্ডিসের জন্য মেন্দুর পাতা বেটে খেতে হয়, শ্রী বাত্তিয়া (মিনা ঘা) হলে কাঁচা কচিপাতা চিবোতে হয়।
• বারিং (বেগুন): ডায়াবেটিস, বদহজমে এর কাজে লাগে। এর শিকড় মায়েদের দুধ বাড়া/ফোলার জন্যে কাজে লাগে।
• ফাসিম (গন্ধবাদালি): বদহজম, আমাশয়, শুক্রতারল্যে এর পাতা এবং এর শ