রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ব্লগসগারোদের বিশ্বাস ও বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব

গারোদের বিশ্বাস ও বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব

গারোদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের সৃষ্টিতত্ত্বের মিথ (Myth) বা পুরাণ কাহিনীটি নিম্নরূপ-
সৃষ্টির আদি অবস্থায় বিশ্বজগৎ বলতে কিছুই ছিল না। এই পৃথিবীর চারদিকে তখন নিঃসীম কালো ঘোর-অন্ধকার ও অসীম জলরাশিতে পরিপূর্ণ ছিল।

চারদিকে কেবল পানি আর পানি ছাড়া কোথাও আলো, ভূমি, প্রাণী বা গাছ পালার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এ অবস্থায় তাতারা-রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টি করার কথা চিন্তা করলেন। তাঁর এই জাগ্রত ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর সহকারী দেবতা নস্তু-নপান্তুকে মনোনীত করলেন। নস্তু-নপান্তু একজন স্ত্রীলোকের বেশে তাঁর সহকর্মী ‘মাচি’র সহায়তায় পৃথিবী সৃষ্টির কাজে মনোনিবেশ করলেন।

গারোদের বিশ্বাস

নস্তু-নপান্তু প্রথমে পানির ওপর বিছানো মাকড়সার জালে আশ্রয় নিলেন। তাতারা-রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টি করার জন্য তাঁর হাতে এক মুঠো বালি দিয়েছিলেন। নস্তু-নপান্তু সেই এক মুঠো বালি দিয়ে প্রথমে পৃথিবীর আকার তৈরি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনোমতেই তিনি তা একত্র করতে পারলেন না।

ওই কাজে তাঁকে সাহায্য করার জন্য কর্কটাকৃতির অতিকায় এক প্রাণীকে তিনি গভীর পানির তলদেশ থেকে কিছু কাদামাটি নিয়ে আসার জন্য প্রেরণ করলেন। কিন্তু পানির গভীরতা খুব বেশি থাকায় তার পক্ষে মাটি নিয়ে আসা সম্ভব হলো না। কাজেই সে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলো। সবশেষে নস্তু-নপান্তু ‘চিচিং-বারচিং’ নামক ছোট এক প্রাণীকে ওই কাজে নিযুক্ত করলেন।

চিচিং-বারচিং গভীর পানির তলদেশে প্রবেশ করে কিছু কাদামাটি নিয়ে ফিরে এলো। আর সেই কাদামাটির সাহায্যে নস্তু-নপান্তু তখন এই পৃথিবী সৃষ্টি করলেন।

পৃথিবী সৃষ্টি

নস্তু-নপান্তু পৃথিবী সৃষ্টি করে এর নাম দিলেন মানোপিল্টো। পৃথিবীর বৃহদাকৃতির পাথর মজার আর ছোট আকৃতির পাথর ডিনজার ছাড়াও পৃথিবীর উপরিভাগ তখনো খুবই নরম ছিল। এর ওপর দিয়ে হাঁটা ছিল তখন অসম্ভব। এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করার জন্য নস্তু-নপান্তু তাতারা-রাবুগাকে অনুরোধ করলেন।

তাতারা-রাবুগা নস্তু-নপান্তুর প্রার্থনা শুনে আকাশে সূর্য ও চন্দ্র দিলেন এবং মর্তে দিলেন বাতাস। সূর্যের আলো, চন্দ্রের কিরণ এবং মর্তের বাতাসে পৃথিবীর উপরিভাগ ধীরে ধীরে শক্ত ও কঠিন হয়ে উঠল।

প্রাণী সৃষ্টি

তাতারা-রাবুগা পৃথিবীকে একটি অন্তর্বাস দান করলেন। তিনি মেঘের তৈরি একটি ‘পাগড়ি’ও তার মাথায় পরালেন। মাথায় চুলের শোভা বৃদ্ধির জন্য তিনি তার মাথায় আমফাং, প্রাপ বৃক্ষের মূলের মতো তার মাথায় চুলও দান করলেন। প্রাণীদের মধ্যে তাতারা-রাবুগা প্রথমে লেজবিহীন বানর-জাতীয় একটি প্রাণীকে সৃষ্টি করেন।

এই প্রাণীর কাজ ছিল তার বিকট আওয়াজ দ্বারা পৃথিবীকে সচল ও সজাগ করে রাখা। বিশ্ব প্রকৃতি যাতে ক্লান্তিতে অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় ঝিমিয়ে না পড়ে তার যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই প্রাণীকে। এরপর তিনি হনুমান ও বাদামি রঙের বানর সৃষ্টি করেন। একইভাবে পরে অন্যান্য প্রাণী সৃষ্টি করেন তিনি।

ব্যাঙ সৃষ্টি

জলচর প্রাণীর মধ্যে প্রথমে তিনি একটি বৃহদাকৃতির কদাকার ব্যাঙকে সৃষ্টি করলেন। এই ব্যাঙের কাজ ছিল তার বিকট আওয়াজ দ্বারা অন্য জলচর প্রাণীর কাছে আকাশে মেঘের আগমন বার্তা ঘোষণা করা। ব্যাঙ সৃষ্টির পর তিনি গভীর জলের অন্য মাছগুলো সৃষ্টি করেন।

পৃথিবী সৃষ্টির পর তাতারা-রাবুগা দেখতে পেলেন মাটির নিচে অনেক পানি আছে। কিন্তু পৃথিবীর উপরিভাগে কোথাও এক ফোঁটা পানি নেই। তখন তিনি পৃথিবীর বুকে নদী প্রবাহিত করলেন। কঠিন এই ধরার বুকে বারিধারা সিঞ্চনের নিমিত্ত তিনি আকাশে নরে-চিরে-কিম্রে-বক্রে নাম্নি বৃষ্টিদেবীকে পাঠালেন। আকাশে বৃষ্টির আগমন বার্তা ঘোষণা করার জন্য তিনি গোয়েরা (বজ্র)-কেও পাঠালেন।

মানুষ সৃষ্টি

তাতারা-রাবুগা পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টির অব্যবহিত পর সৃষ্টি করলেন ‘মানুষ’। আদি গারো ধর্মে বিশ্বাসীদের মতে, প্রথম মানব-মানবীর নাম হলো ‘শানী’ ও ‘মুনি’। তাতারা-রাবুগার আদেশে তাতারা-রাবুগা প্রাচ্যের ‘আমিতিং-আফিল্জাং’ নামক কোনো এক স্থানে গারোদের আদি পিতা-মাতা ও প্রথম নারী-পুরুষ এই শানী ও মুনিকে সৃষ্টি করেন। তাদের সন্তানদের নাম হলো ‘গানচেং’ আর ‘দুজং’।

এই গানচেং এবং দুজংই হলো বর্তমান গারো জাতির পূর্বপুরুষ। বর্ণিত উপাখ্যানে সাংসারেক গারোদের নিম্নবর্ণিত দেবদেবীর অস্তিত্ব স্বীকৃত- পৃথিবী সৃষ্টির দেবতা তাতারা-রাবুগা বিশ্ব সৃষ্টিতে সাহায্যকারী দেবতা নস্তু-নপান্তু, নস্তু-নপান্তুর সহায়তাকারী মাচি; যিনি প্রকৃত প্রস্তাবে গারোদের প্রথম নারী দেবতা।

নরে-চিরে-কিমরে-বকরে বৃষ্টির দেবতা, সালজং সূর্যের দেবতা এবং গোয়েরা বজ্রপাতের দেবতা। সাংসারেক গারোদের মধ্যে এসব দেবতাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কৃত্য বা Ritual আজ অবধি প্রচলিত।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য