অন্যান্য সমাজের মতো গারোদের পারিবারিক জীবন ও প্রথা ও রীতিনীতিবদ্ধ। গারোদের সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ নাকি মাতৃসূত্রিয় সমাজ বলা হবে- তা নিয়ে যেমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে, তেমনই গারোদের পরিবারকে যৌথ পরিবার বলা হবে; নাকি একক পরিবার বলা হবে- তা নিয়েও আধুনিক শিক্ষিত সমাজে, লেখক গবেষক সমাজে এমনকি গারো সমাজেও কিছুটা মত পার্থক্য রয়েছে। পরিবারের সংজ্ঞা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করে লেখাটাকে দীর্ঘায়িত না করাই উত্তম।
গারোদের পারিবারিক জীবন
পরিবার গঠন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপ হিসাবে পুরুষকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়; অর্থাৎ মেয়ের বাড়িতে ছেলেরা জামাই হিসাবে আসবে এবং শ্বশুরবাড়িটাই ছেলেদের স্থায়ী বাসস্থান হবে- এটাই গারো সমাজের আদিম প্রথা। গারোদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিবাহ রয়েছে যা এই গ্রন্থেই উল্লেখ রয়েছে।
পদ-মর্যাদাভূক্ত ও সম্মান
সামাজিক বা গোষ্ঠীগত প্রথায় গারোদের প্রতিটি পরিবারের যেকোন একজন মেয়েকে (বেশীরভাগ ছোট মেয়েকে) নকনা হিসাবে অর্থাৎ পরিবারের উত্তরাধিকারিণী নির্বাচন করা হয়ে থাকে। এই নকনার স্বামীকে বলা হয় নক্রম। বলাই বাহুল্য যে, নকনা-নক্রম নির্বাচনের পর ঐ পরিবারের পিতামাতা বা শ্বশুর-শাশুড়ির সমতুল্য পদ-মর্যাদাভূক্ত ও সম্মান পেয়ে থাকে।
একমাত্র নকনা বা নক্রমের (পরিবারের নির্বাচিতা কন্যা এবং জামাতা) পরিবারে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি এমনকি স্ত্রীর নানা-নানি সকলেই থাকে এবং পরিবারের সকলের দায়িত্ব থাকে এই নকনা-নক্রমের উপর। স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলে শ্বশুর শাশুড়ির দেখাশুনা করে, অসহায় অক্ষম বৃদ্ধ নানা-নানিদের এমনকি পরিবারের সকল চ্রা-দের বিপদ-আপদকালিন বা যে কোন ভালো-মন্দের দায়িত্ব পালন করে থাকে।
নক্রমকে
শ্বশুর-শাশুড়ির যেকোন পারিবারিক দায়িত্ব (ছেলে-মেয়েদের ব্যক্তিগত খরচ, চিকিৎসা, পড়ালেখা, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি) এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও এর পেছনে সকল খরচের ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকা নক্রমকেই পালন করতে হয়।
পরবর্তীতে শ্বশুরের অচলাবস্থায় বা মৃত্যুর পর এই নক্রমই তার শ্বশুরের পদ অধিকারপ্রাপ্ত হয় এবং পরিবার পরিচালনা এবং পারিবারিক সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়নের অধিকার লাভ করে। বাদবাকি বোনদেরকে পারিবারিকভাবে বলা হয় আগাত্তে; আর তাদের স্বামীদেরকে বলা হয় চাওয়ারি। আগাত্তে মেয়েদের বিবাহের পর কিছুদিন বা কিছুকাল স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত পিতামাতার পরিবারে বসবাস করার সুযোগ পেয়ে থাকেন এবং পরবর্তীতে আলাদা বসতভিটায় গিয়ে ঘর-সংসার করতে হয়।
আগাত্তে
আগাত্তে মেয়ে বা কন্যাদের পরিবারে শুধুমাত্র তারা অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরাই থাকেন। সুতরাং যেহেতু একটা পরিবারের একাধিক মেয়ে থাকলেও তারা সকলেই এবং তাদের স্বামী-সন্তানরা পিতামাতার পরিবারে যৌথভাবে বসবাস বা ঘর সংসার করে না, সেহেতু গারোদের পরিবারকে যৌথ পরিবার বলা যায় না।
আমরা অনেক শিক্ষিত গারোদের সাথে আলাপকালে তাঁরাও গারোদের পরিবারকে যৌথ পরিবার বলে মানতে চান না। অথচ অতীতে অনেক লেখক গবেষক গারোদের পরিবারকে যৌথ পরিবার বলে উল্লেখ করেছেন।
পারিবারিক মূল্যবোধ
অন্যান্য জাতির পরিবারের চেয়ে গারোদের পারিবারিক মূল্যবোধ কোন অংশেই কম নয়, বরং বলা যায় ক্ষেত্র বিশেষ অনেক উপরে। গারো পরিবারে পুরুষ বা গৃহকর্তা কর্তৃক কোন স্ত্রী বা সন্তানদের নিগৃহীত হতে হয় না।
তেমনই, স্বামীরা স্ত্রীর পরিবারে বা শ্বশুরবাড়িতে জামাই হিসাবে আসলেও তার স্ত্রীর দ্বারা অপমানিত, তুচ্ছ্ব-তাচ্ছ্বিলের শিকার হতে হয় না। পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ যেমন শ্বশুর শাশুড়ি, নানানানি, চ্রাদের এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু সন্তানদের অধিকার থাকে সর্বাগ্রে।
প্রবীনদের প্রতি সম্মানবোধ আমরণ সেবা যত্ন আন্তরিকতার সাথে পালন করে থাকে। ছোটদের প্রতি আদর, স্নেহ ভালোবাসা, সেবা শুশ্রুষা হতে কাউকেই বঞ্চিত হতে হয় না; এমনকি সৎ ছেলে-মেয়ে, নিকটাত্মীয় বা নিজ গোত্রের কোন অনাথ সন্তানদেরকেও বিনা বাক্যে সন্তানের মতো লালন-পালন করে থাকে। বলা যায়, একারণে গারোদের পরিভাষায় ভিক্ষুক, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা বলে কোন শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না।
পারিবারিক দায়িত্ব
পুরুষরা মাঠে কাজ করবে বা উপার্জন করবে, আর নারীরা ঘরের কাজকর্ম সামলাবে- প্রচলিত এমন রীতি বা সংস্কার প্রায় সমাজের অন্যতম উদাহারণ; কিন্তু গারোদের পারিবারিক রীতি এমন নয়।
পারিবারিক সম্পত্তির একচ্ছত্র অধিকারী না হয়েও গারো পুরুষদের পারিবারিক দায়িত্ব পালন অন্যান্য সমাজের পুরুষদের তুলনায় আরোও বেশি উদার এবং আন্তরিক। পারিবারিক অন্যান্য জাতির পরিবারের মতো গারো সমাজেও পরিবারের কর্তা থাকেন পিতা বা শ্বশুর।
কর্তা হিসাবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ভালো-মন্দের দায়িত্ব এবং সহায় সম্পত্তির রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্ব পুরুষের উপর ন্যাস্ত থাকে। আর চ্রা হিসাবেও নিজ গোষ্ঠীর সকলের উপরে এবং তাদের সম্পদের উপরে সিদ্ধান্ত বা মতামত আদান-প্রদানের ক্ষমতা থাকে প্রতিটি গারো পুরুষের।
অন্যদিকে স্ত্রী/শাশুড়িকে গৃহকর্তৃর ভূমিকা পালন করতে হয়। সাংসারিক কর্মে পুরুষের পাশাপাশি সকল নারীই অবলীলায় মনোনিবেশ যেমন করতে পারে; তেমনই নিজ গোষ্ঠীর ভেতরে আমা-মানক হিসাবে অন্যান্য পরিবারেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
গারোরা পুরুষ নারী নির্বিশেষে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার সামাজিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। অন্যদিকে পরিবারের সকল ছেলে সন্তান চ্রা-পান্থে হিসাবে গোষ্ঠির সবার কাছে সম্মানিত হয়ে থাকে।
পরিবারের মেয়ে সন্তানদের বড় ও ছোট ভাই এবং সব ক’টি মামার সমন্বয়ে এই চ্রা-পান্থে দল গঠিত। এই চ্রাগণ নিজ গোষ্ঠীতে পারিবারিক বিষয় এবং সম্পত্তি রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। কোন পরিবার বা গোষ্ঠির সমস্যা, বিবাদ, অমিল, মতানৈক্য ইত্যাদি নিরসনের দায়িত্ব এই চ্রাদের উপর।
এককথায় বলা যায়- ধর্মীয়, সামাজিক এবং প্রথাগত আইন সংক্রান্ত যেকোন সমস্যায় পরিবারের মেয়েদের পক্ষাবলম্বন করা এবং তাদের স্বার্থরক্ষা করা এই দলের দায়িত্ব। আবার, যেকোন বিপদাপদ অথবা সমস্যাকালে পরিবারের প্রতিটি ছেলে সন্তানের পাশে দাঁড়ানো এবং এর যে কোন সমস্যা মোকাবেলা করার দায়িত্ব ফা-গাছিদের উপর। পরিবারের ছেলে সন্তানদের বড় বোন এবং ছোট বোন ও তাদের স্বামীরা, মাসীমারা ও মেসোমশাইরা এই দলের অন্তর্ভূক্ত।
পারিবারিক অধিকার
পরিবার পরিচালনায় গারো পুরুষের পূর্ণ স্বাধিনতা বা অধিকার থাকলেও পরিবারের সমূহ সম্পত্তি এবং ছেলে-মেয়েদের উপর একচ্ছত্র অধিকার থাকে মা/শাশুড়ির কাছে। সন্তানদের লালন-পালন, শাসন, ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব এবং পরিবারের প্রয়োজনে জমি-জমা বা অন্যান্য সম্পত্তির ক্রয় বিক্রয়ের অধিকার পুরুষ/পিতার হাতে থাকে।
তবে, যে কারণেই হোক সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় বা ভাগবাটোয়ারার প্রয়োজন হলে স্ত্রী/শাশুড়ি এবং চ্রা-মানকদের মতামতের ভিত্তিতে করাটাও স্বামী/পিতাকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। কোন কারণে পুরুষ/স্বামী স্ত্রীর পরিবার ছেড়ে বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের ফলে অন্যত্র চলে গেলেও গেলেও কোন পুরুষ সম্পত্তি বা ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে যেতে পারেন না।
মূলত, গারো সমাজে বা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের অধিকার নিশ্চিত করাকে গারোরা প্রাধান্য দিয়ে থাকে; অন্যথায় গারো সমাজের ভেতরেই স্ব-স্বগোষ্ঠিতে আলাপ-আলোচনা বা সালিশ বিচারের মাধ্যমে অধিকার ফিরে পাওয়ার সুযোগ পেতে পারে।
পারিবারিক বা সাধারণ শিষ্টাচার:
- পারিবারিকভাবে বয়োজ্যাষ্ঠ সকলেই শ্রদ্ধার পাত্র, তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদান করা উচিত।
- বয়োজ্যাষ্ঠদের উপস্থিতিতে দৃষ্টিকটু আচরণ করা যাবে না; এমনকি ছোটদের উপস্থিতিতেও এসব করা যাবে না।
- গৃহাভ্যন্তরে কোন পুরুষ উপবিষ্ট থাকলে কোন মহিলা ঘরের দরজায় প্রকাশ্য স্থানে দাঁড়াবে না। বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে যদি কোন মহিলাকে ঘরের ভেতরে বাইরে যাতায়ত করতে হয় তবে সে উত্তমরূপে নিজের পশ্চাদ্দেশ কাপড় দিয়ে ঢেকে যেতে হবে।
- গুরুজনদের উপস্থতিতিতে বা বাড়িতে কেউ শিস দিবে না। এমনকি কারোর সাথে হাস্যরস, ঠাট্টা পরিহাস, বা অশ্রাব্য কটুভাষা ব্যবহার করবে না।
- মেয়েরা বিশেষভাবে অবিবাহিত মহিলারা তাদের কাকা, মামা, বড় ভাইদের পরিধেয় বস্ত্র স্পর্শ করবে না।
- কোন মুরুব্বী শ্রেণীর লোক যদি বাড়ির ভেতর বসে বা দাঁড়িয়ে থাকেন অথবা বাইরেও যদি বসে থাকেন, তাদের সামনে দিয়ে বা ডিঙ্গিয়ে কোন মেয়ে/মহিলা হাঁটবে না।
- কোন পুরুষ কোন মহিলার ব্যবহৃত বস্ত্র ব্যবহার করবে না। মহিলারাও কোন পুরুষের পরিধেয় বস্ত্র ব্যবহার করবে না।
- কোন অভিভাবক বা বয়োজ্যাষ্ঠ নবদম্পতি, বা ছেলে-মেয়ের রুমে বিনা কারণে বা সামান্য প্রয়োজনে প্রবেশ করবে না। এমনকি তাদের অনুপস্থিতিতেও না। তবে, প্রয়োজনে আগাম বার্তা বা সংকেত দিয়ে প্রবেশ করতে পারে।
- কোন পুরুষ তার স্ত্রীর বড় বোন, শাশুড়ি সম্পর্কের কারোর সাথে ঠাট্টা বা হাস্যরস করবে না। মহিলারাও শ্যালিকা, বৌদি এবং বান্ধবী ছাড়া কারোর সাথে ঠাট্টা মশকরা করবে না।
- কোন পুরুষ মানকদের সাথে বা তাদের উপস্থিতিতেও অশোভন কথাবার্তা বা ঠাট্টা করবে না।
- কোন বিবাহিতা মহিলা শশুর সম্পর্কীয় এবং ভাশুর সম্পর্কীয় কারোর সাথে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবে না।
- কোন মেয়ে বা মহিলা যুবকদের ঘরে প্রবেশ করবে না। তবে বিশেষ প্রয়োজনের পেছনের দরজা দিয়ে প্রবীণা মহিলারাই অনুমতি সাপেক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন।
- কোন পরিবারে অতিথি আসলে তাকে বিনয়ের সাথে খাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া গৃহকর্তা/গৃহকর্তীর কর্তব্য।
- কোন গৃহিণী তার স্বামীকে, বাইরের কোন পুরুষকে হাড়ির তলদেশের পোড়াভাত বা তরকারি পরিবেশন করবে না।
- কাউকে কোন জীবজন্তুর বাচ্চা বলে গালি দেওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে এই গালিটা চলে যায় তার পিতা-মাতার উপর।
- ক্রোধবশত বয়োজ্যষ্ঠদের গায়ে হাত তোলা যাবে না; এমনকি তাঁদের উদ্দেশে হাত বা আঙ্গুল উঁচিয়ে কথা বলা যাবে না।
- কেউ যতোই খারাপ ব্যবহার করুক না কেন, কারো অমঙ্গল কামনা বা অভিশাপ দেওয়া যাবে না।
এতদসত্ত্বেও আধুনিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, জীবিকার ক্রমবিকাশ, বৃহত্তর সমাজের সামাজিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ইত্যাদির প্রভাবে গারো সমাজের পরিবারেও কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা দিয়েছে। এই পরিবর্তনের ভালো মন্দ উভয় দিকই হয়তো আছে। কিন্তু গারোদের আদি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে সামাজিক এই অসম বিবর্তনে ভালোর তুলনায় মন্দের অনুপ্রবেশও কম নয়।