প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি মানুষই তাদের ঐতিহ্যগত কতকগুলি রীতিনীতি ও সামাজিক বিধিবদ্ধ দ্বারা আবদ্ধ। গারোদের জীবনধারা তে এর ব্যতিক্রম নয়। এই রীতিনীতি ও সামাজিক বিধানগুলো তাদের সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত যা অনেকটা জাতিগত, সামাজিক, পারিবারিক প্রথা হিসাবে আদিকাল থেকে মেনে আসছে।
তাই সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে কেউ এগুলোকে অমান্য করলে তাকে গারোরা তাকে নির্লজ্জ, অবিবেচক এবং অথেষ্ট শিষ্টাচারের অভাব রয়েছে মনে করে।
খামাল দিনেশ নকরেক এবং অন্যান্য অনেক প্রবীণ ব্যক্তিদের অভিমত, আমাদের সমাজে এমন কিছু কালচার বা প্রথা রয়েছে, যেগুলো গারোদের আইন নয় ঠিক, কিন্তু আইনের প্রায় কাছিকাছি এবং আসি_মালজা” বা খ্রা চাআত্তাগিপ্পা”-এর পর্যায়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে এসব অমান্যকারীকে সামাজিকভাবে তিরস্কৃত হতে এবং অনেক সময় মৃদু শাস্তি বা জড়িমানার দায়ে পড়তে হয়।
গারোদের জীবনধারা সাধারণ শিষ্টাচারের বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
- পারিবারিকভাবে বয়োজ্যাষ্ঠ সকলেই শ্রদ্ধার পাত্র, তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদান করা এবং কোনক্রমেই তাদের উপস্থিতিতে দৃষ্টিকটু আচরণ করা যাবে না। এমনকি ছোটদের উপস্থিতিতেও এসব করা যাবে না।
- গৃহাভ্যন্তরে কোন পুরুষ উপবিষ্ট থাকলে কোন মহিলা ঘরের দরজায় প্রকাশ্য স্থানে দাঁড়াবে না। বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে যদি কোন মহিলাকে ঘরের ভেতরে বাইরে যাতায়ত করতে হয় তবে সে উত্তমরূপে নিজের পশ্চাদ্দেশ কাপড় দিয়ে ঢেকে যেতে হবে।
- গুরুজনদের উপস্থতিতিতে বা বাড়িতে কেউ শিস দিবে না এমনকি কারোর সাথে হাস্যরস, ঠাট্টা পরিহাস, বা অশ্রাব্য কটুভাষা ব্যবহার করবে না।
- মেয়েরা বিশেষভাবে অবিবাহিত মহিলারা তাদের কাকা, মামা, বড় ভাইদের পরিধেয় বস্ত্র স্পর্শ করবে না
- কোন মুরুব্বী শ্রেণীর লোক যদি বাড়ির ভেতর বসে বা দাঁড়িয়ে থাকেন অথবা বাইরেও যদি বসে থাকেন, তাদের সামনে দিয়ে বা ডিঙ্গিয়ে কোন মেয়ে/মহিলা হাঁটবে না।
- কোন পুরুষ কোন মহিলার ব্যবহৃত কোন বস্ত্র ব্যবহার করবে না। মহিলারাও কোন পুরুষের পরিধেয় বস্ত্র ব্যবহার করবে না।
- কোন অভিভাবক বা বয়োজ্যাষ্ঠ নবদম্পতি, বা ছেলেমেয়ের রুমে বিনা কারণে বা সামান্য প্রয়োজনে প্রবেশ করবে না। এমনকি তাদের অনুপস্থিতিতেও না। তবে, প্রয়োজনে আগাম বার্তা বা সংকেত দিয়ে প্রবেশ করতে পারে।
- কোন পুরুষ তার স্ত্রীর বড়বোন, শাশুড়ি সম্পর্কের কারোর সাথে ঠাট্টা বা হাস্যরস করবে না। মহিলারাও শ্যালিকা, বৌদি এবং বান্ধবী ছাড়া কারোর সাথে ঠাট্টা মশকরা করবে না।
- কোন পুরুষ মানকদের সাথে বা তাদের উপস্থিতিতেও অশোভন কথাবার্তা বা ঠাট্টা করবে না।
- কোন বিবাহিতা মহিলা শশুর সম্পর্কীয় এবং ভাশুর সম্পর্কীয় কারোর সাথে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবে না।
- কোন মেয়ে বা মহিলা যুবকদের ঘরে প্রবেশ করবে না। তবে বিশেষ প্রয়োজনের পেছনের দরজা দিয়ে প্রবীণা মহিলারাই অনুমতি সাপেক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন।
- কোন পরিবারে অতিথি আসলে তাকে বিনয়ের সাথে খাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া গৃহকর্তা/গৃহকর্তীর কর্তব্য।
- কোন গৃহিণী তার স্বামীকে অথবা বাইরের কোন পুরুষকে হাড়ির তলদেশের পোড়াভাত বা তরকারি পরিবেশন করবে না।
- চু পান করার আগে সর্বপ্রথমে বাইরে (অথবা খিম্মাতে) কিছু পরিমান ফেলে দিতে হয়। এবং চু পানকারীরাও শুরুতে গ্লাসথেকে সামান্য পরিমান (কয়েক ফোটা) চু মাটিতে ফেলে তারপর খাবেন।
সামাজিক শিষ্টাচার
- গারো সমাজের কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে সামাজিক মর্দাযা অনুসারে আসনের শ্রেণিবিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম সারিতে বা বয়োজ্যাষ্ঠ বা চ্রাগণ, পরের সারিতে অন্যান্য সাম্মানিত ব্যক্তি বা অতিথিগণ এবং এর পরের সারিতে যুবক শ্রেণীর লোকেরা বসবেন।
- মহিলারা উক্ত আসনগুলোতে বসতে পারবেন না। তাদের জন্য আলাদা পেছনে বা কাছাকাছিতে বসার ব্যবস্থা করবেন।
- সামাজিক বা পারিবারিক আলোচনার শুরুতে প্রথমে মুরুব্বী বা চ্রাদের মধ্যথেকে গ্রো-দক্কা বা কথাবলা শুরু করবেন এবং মুরুব্বী, চ্রা বা সভাপতির কথার ফাঁকে কারোর কথা বলা বা বাঁধা প্রদান করা অশোভন এবং অসভ্যতা বলে গণ্য হয়।
- মুরুব্বী, চ্রা এবং প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ থাকাকালীন কোন মহিলা সভাপতিত্ব করবে না এবং বয়সে ছোট হলে চ্রাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান দিয়ে এবং অনুমতি নিয়ে কোন প্রস্তাব বা সাক্ষ্য দিতে পারবেন।
- চু খাওয়ার সময় উৎকৃষ্ট চু (প্রথম প্রস্তুতকৃত চু) প্রথমে সবচেয়ে প্রবীণ বা সম্মানিত ব্যক্তিকে এবং ঘরোয়া পরিবেশে হলে বাড়ির কর্তাকে দিবেন।
- চুপানের সময় গারোরা অতিথি বা আগতদের চু খাইয়ে থাকেন- এটাও যেমন একটা শিষ্টাচার তেমনই পাল্টা চু খাইয়ে দেওয়া বা প্রস্তাব দেওয়াও একটা শিষ্টাচার।
- চু পানের আসরে কিংবা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মামা, কাকা, শ্বশুর সম্পর্কীয় কারোর আসনে (কিছুক্ষণের জন্য আসন খালি থাকলেও) কেউ বসবে না।
- পথ চলার সময় মেয়েরা সবসময় পুরুষের পিছে পিছে হাঁটবে। কেবলমাত্র হিংস্র শ্বাপদসংকুল অথবা অন্য কোন বিপদজনক পথে সম্পূর্ণ নিরাপত্তার স্বার্থে মেয়েরা পুরুষের আগে হাঁটতে পারবে। অবশ্য অল্প বয়স্কা কুমারী কন্যা তাঁর পিতার আগে অথবা বিবাহিতা স্ত্রী তাঁর স্বামীর আগে হাঁটতে পারবে।
- পথ চলার সময় কোন অগ্রগামী কোন কাউকে পথ অতিক্রম করতে চাইলে কিছুদূর হতে মুখে কোন রকম আওয়াজ তুলে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করবে। অগ্রগামী মেয়ে বা মহিলা হলে যাতে সে/তারা রাস্তার উল্টাদিকে মুখ ফিরিয়ে একপাশে সড়ে দাঁড়াতে পারে।
- পাহাড়ি গারোরা নির্জন পাহাড়ি ঝর্ণায় অথবা নদী-খালে নগ্ন বা অর্ধনগ্ন অবস্থায় স্নান করে থাকে। ঐ রকম পাহাড়ী ঝর্ণা অথবা খালে যেতে হলে বেশ কিছুদুর থাকতে মুখে কোনভাবে আওয়াজ করে নিজের উপস্থিতি ঘোষনা করে যেতে হয়, যাতে স্নানরত মহিলা বা পুরুষ নিজেকে বস্ত্রে আচ্ছাদন করার যথেষ্ট সময় পেতে পারে।
ধর্মীয় শিষ্টাচার
- যখন তখন দেবতাদের নাম নিবে না এবং তাদের নামে কোনরকম প্রতিজ্ঞা, শপথ নেওয়া যাবে না।
- পূজার জায়গায় কেউ অকারণে যাতায়াত করবে না, থুথু ফেলবে না এবং পায়খানা প্রস্রাব করবে না।
- পূজায় ব্যবহৃত বাশ, কাঠ, লতাপাতা কেউ ব্যবহার করবে না।
- খামালরা যখন পূজা পরিচালনা বা মন্ত্রপাঠ করেন, তখন কেউ গোলমাল করবে না।
- রংচুগাল্লা এবং ওয়ানগালার আগে কেউ জমির নতুন ফসল খাবে না।
- ধর্মীয় ভোজসভার বাড়তি কোন খাবার, মাংস, চু ইত্যাদি সঞ্চয় বা অন্যের বাড়িতে নিতে/দিতে নেই।