গারোদের উপমহাদেশে আগমন ও অবস্থান সম্পর্কে গারো গবেষক, বরেন্দ্র লেখক মণীন্দ্রনাথ মারাক তাঁর গারো নামের ইতিবৃত্ত প্রবন্ধে যা লিখেছেন, এ নিবন্ধের শুরুতে তাঁর কিছু অংশ তুলে ধরছি । প্লিনি গারো পাহাড়কে মালেয়াস পাহাড় এবং এই পাহাড়ের আদিবাসীদের মান্দাই (মান্দে>মান্দাই>মান্দি>মানুষ) বলেছেন (ম্যাগাস্টেনিস এরিয়ান)।
টলেমির ভূগোল পুস্তকে কিরাত জাতির সঙ্গে গারিওনি জাতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি গারো পাহাড়কে মৈরন্তুম পর্বত বলেছেন। তিনি হয়তো রামায়নে উল্লেখিত মন্দর বা মিন্দিরকে মৈরন্তুম পাহাড় বলেছেন।
তিনি পাতালিপুত্র থেকেই এই অঞ্চলের তথ্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন। তাই জাতির নাম ও স্থানের মানগুলি অপভ্রংশ হয়েছে। খুব সম্ভব গারো নাম লোকমুখে শুনে এবং অপভ্রংশ করে গারো শব্দকে গারিওনি লিখেছেন। টলেমীর জীবনকাল খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দী। আর প্লিনি যিনি ন্যাচারাল হিষ্ট্রিতে গারোদের মান্দাই বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর জীবনকাল ছিলো খ্রিষ্টীয় ১ম শতাব্দী।
গারোদের উপমহাদেশে আগমন এর ইতিহাস
ইতিহাস বলে, গারো জাতি ছিলো যাযাবর জাতি।
ড: মজহারুল ইসলাম তরু তাঁর গ্রন্থে বলেছেন , গারোদের আগমনকালকে আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বে ধরে নেয়া হয়। কিন্ত প্রশ্ন হলো কোথায় ছিলো এ গারো জাতির মানুষেরা।
ঝুমচাষ প্রেমী গারো জাতি যেখানেই পাহাড় জঙ্গল পেয়েছে, সেখানেই কয়েক বছরের জন্য আবাস গেড়েছে। আবার যখনই দেখেছে একই জায়গায় প্রত্যাশানুরূপ ফসল হচ্ছে না, তখনই অনত্র সড়ে গিয়ে সেখানে আবার কয়েক বছরের জন্য ঝুমচাষ করার উদ্দেশে আস্তানা গেড়েছে- গারোদের ইতিহাস, জীবন বৈচিত্র তাই বলে।
গারোরা জাতিগতভাবে আসলেই সহজ সরল, শান্তিপ্রিয়
গারোরা জাতিগতভাবে শান্তিপ্রিয় তাই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ও । এ গারো জাতি পারতপক্ষে কারোর সাথে দলাদলিতে যেতে চায় নি বিধায় কোথাও বেশিদিন কারোর উপরে কর্তৃত্বও করে নি, অন্যদিকে কারোর কাছে মাথানত, বশ্যতা স্বীকার করেও চলতে চায় নি।
ইচ্ছায় হোক, আর অনিচ্ছায় হোক, যেখানেই গেছে, থেকেছে কিন্তু কোথাও দীর্ঘস্থায়ীভাবে বসবাস করে নি। একারণে এককথায় গারোদের বসবাসের ভৌগলিক অবস্থান নির্ণয় করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার ।
প্রাচীন ব্যক্তিবর্গের মতামত
ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের বসবাস সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যপঞ্জি, গ্রন্থ ঘাটিয়ে এবং এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিবর্গের মতামত সাপেক্ষে বলা যায়, গারোদের পূর্ব পুরুষগণ জাতি হিসাবে গারো নাম নিয়েই তিব্বত দেশ থেকে এসেছে এবং পরবর্তীতে গারো পাহাড়ে এসে বসবাস শুরু করেছে।
এই গারো পাহাড়টির নাম গারোদেরই দেওয়া বলে সকলেই দাবী করেছেন। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার কারণে ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিলো এই গারো জাতি এবং সমাজ।
বিভিন্ন তথ্যপঞ্জি, গ্রন্থ ঘাটিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের বসবাস সম্পর্কিত তথ্যপঞ্জি নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে দেওয়া হলো-
ক)১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত সুভাষ জেংচাম রচিত বাংলাদেশের গারো আদিবাসী নামক বইটির ৯ম পৃষ্ঠায় গারোদের জনসংখ্যা সম্পর্কে লিখেছেন- গারোরা ভাষা অনুযায়ী বোডো মঙ্গোলীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
খ)বৃটিশ শাসনামলে শুরুতে টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের গারোদেরকে নাটোরের রানী ভবানীর প্রজা হিসাবে চিহ্নিত হতে দেখা যায় এবং সে মর্মে তাদে ভূমিস্বত্বের কাগজপত্রাদিও পাওয়া যায়। (সুভাষ জেংচাম)
গ)সুসং দূর্গাপুর এলাকায় গারোরা সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দির শেষ ভাগ পর্যন্ত অত্যন্ত প্রতাবশালী ছিল। ঐ সময়কালে তারা বিভিন্ন দলনেতার নেতৃত্বে সুসং দূর্গাপুরে রাজত্ব করে। অবশেষে শেষ গারো রাজা বাইস্যা মান্দা তার বিশ্বাসঘাতক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মন্ত্রী সমেশ্বর পাঠকের হাতে ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন।
ঘ)৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে চীন পর্যটক হিউয়েন সাঙ কামরূপ ভ্রমণে এসে সাদামাটা প্রকৃতির ছোটখাটো চেহারার ঘন হলুদ ঘেঁসা এক গুয়ে ও বুনো ধরনের প্রখর স্মরণ-শক্তিসম্পন্ন যে মানুষ দেখতে পান বলে তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে উল্লেখ করেছেন, সেই জনগোষ্ঠীই এ অঞ্চলের গারো সম্প্রদায়ের বলে অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন। (আলী আহাম্মদ খান আইয়োব- গারো সম্প্রদায়)
ঙ)ঐতিহাসিক প্রমান পাওয়া যায়,
নেত্রকোনার মদনপুরে এবং সুসং দূর্গাপুরে গারোরাজ্য প্রতিষ্ঠার বিবরণে। জানা যায়- নেত্রকোনার মদনপুরে নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত গারোদের চিরান পদবীর এক সমৃদ্ধ সামন্ত রাজ্য ছিল, যে রাজ্যে গারো মদন চিরান (মদন গারো) ১০৬০ খ্রীষ্টাব্দে ইসলাম ধর্ম প্রচারক হযরত শাহ সুলতান রুমীর হাতে পরাজয় বরণ করেন এবং রাজ্য ত্যাগে বাধ্য হন।
চ)এ অঞ্চলে আর্যদের প্রবেশের পর গারোদের একাংশ হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে চতুর্থবর্ণ শূদ্রের সৃষ্টি হয়। ফলে গারোদের একাংশ সেই শূদ্র বর্ণে প্রবেশ করে। আবার যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে সেই গারো সমাজের লোকজন ক্ষত্রিয় বর্ণের দাবীদার হয়ে পড়ে। (আলী আহাম্মদ খান আইয়োব- গারো সম্প্রদায়)
ছ)আলী আহাম্মদ খান আইয়োব
গারো সম্প্রদায় প্রবন্ধে আরও লিখেছেন- হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণে নাম আছে গারুদা। মহা ভারতেও বলা আছে গারুদা। (দেবতা বিষ্ণু ও দেবী লক্ষ্মীর কাহিনীতে পাওয়া যায় এই গারুদার উপস্থিতি)। এই হচ্ছে গারো বা আচ্ছিক্ মান্দিদের নামের ইতিহাস।
জ)ভগদত্তের কামরূপ রাজত্যকালেই উত্তর ভারতের কুরুক্ষেত্রে কুরু-পান্ডবদের মধ্যে আত্মক্ষয়ী মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই মহাযুদ্ধে রাজা ভগদত্ত তার পরম মিত্র কুরু রাজা দূর্যোধনের পাবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। তার সৈন্যদলে বহু গারো (কিরাত সৈন্য) কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিরত্ব সহকারে অংশগ্রহন করে মৃত্যু বরণ করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা। পন্ডিতদের মতে উহার সংঘটিত কাল তিন হাজার একশত আত্রিশ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার একশত পঞ্চাশ বছর আগে। কাজেই ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের আগমনকালকে আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বে ধরে নেওয়া যায়। (ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু)
ঝ)ডঃ মজহারুল ইসলাম তরু আরও লিখেছেন- গারোদের বিশ্বাস ২৫০০ খ্রষ্টপূর্বাব্দ থেকেই উল্লিখিত (বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও থানা) অঞ্চলসমূহে বসবাস করে আসছে। নৃ-তত্ত্ববিদ Edward Dalton, Robbins Burling প্রমূখ অনুরূপে অভিমত পোষণ করেন।
ঞ)উইকিপিডিয়ায় বলা আছে-
উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। ধারণা করা হয় দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সেসময় বসতি স্থাপন করেছিল। (বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বাংলার ইতিহাস-উইকিপিডিয়া)
ট)Wikipidia এবং Official Homepage of Meghalaya State of India-তে বলা আছে-
According to one such oral tradition, the Garos first came to Meghalaya from Tibet about 400 (BC) years ago under the leadership of Jappa Jalimpa, crossing the Brahmaputra River and tentatively settling in the river valley. It is said that they were later driven up into the hills by other groups in and around the Brahmaputra River. Various records of the tribe by invading Mughal armies and by British observers in what is now Bangladesh wrote of the brutality of the people.
ঠ)নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে, গারোরা তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী (সুভাষ জেংচাম- গারোদের সমাজ ও সংস্কৃতি)।
ড)The Garos own traditions relate that they came originally from Tibet to what is now Cooch Behar, whence they moved on to Dhubri whose king received them warmly. However, later on, being afraid of them, he did not allow them to settle permanently. From there they moved to their neighourhood of Jogighopa where they remained for about 400 years but they were again forced to leave the place, driven towards the south by the ruler of that country, crossed the Brahmaputra on rafts and advanced towards Gauhati, where they settled at Kamagre or present Kamakhya Hills and along the Brahmaputra valley. As the place was infested with tigers, the Garo relinguished the place and then spread into Habraghat Pargana in Goalpara. Tradation also tell us while in the neighbourhood of Habraghat Pargana, the Garo appear to have become rich and prosperous and the first Garo Kingdom was established, of which the first reigning price was Abrasen who has his palace and capital at Sambol Ading, an isolated hill near the Dakaitdol Village not far from Goalpara town”. (Historical Accounts, Official Homepage of Meghalaya State of India)
চূড়ান্ত মতামত
উপরোক্ত সমীক্ষা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের আগমনকালকে আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বে ধরে নেওয়া যায়। নৃ-তত্ত্ববিদদের মতে ভারতবর্ষে মোঙ্গলী প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী তিব্বত, ভুটান, নেপাল, সিকিম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে। ভারতে প্রবেশকারী মোঙ্গলীরা নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
ধারণা করা এদের একটি শাখা প্রথমে তিব্বতের তুরা প্রদেশে ও ভুটানের নকলবাড়ি নামক অঞ্চলে বসতি শুরু করে। এই শাখাকেই ভারতবর্ষে গারোদের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।