গারোদের আদি চিকিৎসায় প্রাথমিক চিকিৎসা করা হতো কাতচি সোআ চি (কাস্তে/লোহা পোড়া পানি), তেলফরা (তৈলপরা) এবং চিফরা (পানিপরা) ইত্যাদির মাধ্যমে।
তৈল বা পানি পড়ায় কাজ না হলে কয়েক হাজার প্রকারের গাছ, লতা, পাতা, ছাল, বীজ দিয়ে তৈরী বনৌষধি ব্যবহার করে অথবা উভয়ভাবেই চিকিৎসার করা হতো। এর পরেও রোগী সুস্থ্য না হলে ফংসির মাধ্যমে সিম্মা নিয়া (রোগ নির্ণয়)-র মাধ্যমে চিকিৎসা করা হতো। নিম্নে চিকিৎসার এই মাধ্যমগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
গারোদের আদি চিকিৎসা পদ্ধতি গুলো
ক) কাতচি সোআ চি (কাস্তে বা লোহা জাতীয় পোড়ার পানি)
কাতচি সোআ চি অর্থাৎ কাস্তে বা লোহা জাতীয় পোড়ার পানি খেয়ে মানসিক বলশক্তি (সুস্থ্যও বলা যায়) ফিরে পায় নি, এমন লোক বোধয় আদি গারোদের মধ্যে একটিও বাদ যাবে না। মুখসন্ধ্যা বা কালিসন্ধ্যায় বাইরে বেরোতে গিয়ে ঝোপঝাপের ভেতর কোন কিছুর আওয়াজ পেয়ে চমকে যায় নি বা রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য কোন কিছুর ছায়া দেখে শরীরের লোম, মাথার চুল খাঁড়া হয়ে যায় নি- জংলি পাহাড়ি এলাকায় এমন লোক কি খুঁজে পাওয়া যাবে? যেখানে যেই চমকে যাক বা ভয় পাক।
বাড়িতে ফিরেই তাঁর প্রথম কাজ হতো পুরানো কাস্তে বা লোহা জাতীয় আগুনে পুড়ে সেই কাস্তে প্রথমে বাঁহাতে, তারপর ডানহাতে এবং শেষেও বাঁহাতে এই মোট তিনবার পাত্রের পানিতে চুবিয়ে সেই পানি পান করা এবং মাথায় বুকে, পিঠে মাখা বা মালিশ করা এবং দু’চোখে ছিটিয়ে দেওয়া। মজার ব্যাপার হলো- ছোটবেলায় আমি নিজেও এমন চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ্য (মূলত মানসিক বলশক্তি) ফিরে পেয়েছি।
খ) জাকমিতচি নিয়া বা হাতের কব্জি পরীক্ষা
আধুনিক বিজ্ঞানে চিকিৎসকগণ যেমন হাতের কব্জি ধরে রক্তচাপ পরীক্ষা করেন, তেমনই গারো কবিরাজদের সবাইকে দেখা যায়- যে কোন রোগীকে হাতের কব্জি ধরে পরীক্ষা করতে। তবে, এই কবিরাজগণ রক্তচাপ পরীক্ষা করতেন রোগীর রোগ নির্ণয় করার জন্যে। উনারা রক্তচাপ অনুভব করেই রোগের কারণ বলে দিতেন এবং চিকিৎসা শুরু করতেন এবং এখনও তা করে থাকেন।
গ) তৈলপরা
আদি গারোদের কেউ তরাস বা তরাইস্যা অসুখের কথা এবং এর চিকিৎসায় তৈলপরার কথা শুনেন নি বললে আপনার বরং অবাক হয়াই উচিত। রোগী কোন কারণে চমকে গেলে, ভয় পেলে, মন্দ আত্মা বা ভুত, শয়তান ইত্যাদি দেখে ভয় পেলে বা আছর হলে তাকে সাথে সাথে সরিষার তৈলে তৈলপরার মালিশ দেওয়া হতো। কারোর হাড় এবং পেশীর ব্যথাতেও এই তৈলপরা দিয়েই চিকিৎসা করা হতো এবং এই পদ্ধতিটি গ্রামাঞ্চলে এখনও প্রচলিত।
ঘ) পানিপরা
পূজার স্থান, ঘরবাড়ি বা কবরস্থান ইত্যাদি জায়গাগুলো পানিপরা পানি ছিটিয়ে শুচি করার প্রচলন এখনও রয়েছে। মন্দ আত্মায় আক্রান্ত বা ভূতে পাওয়া লোককে চিকিৎসার প্রধান উপকরণ হচ্ছে মাছধরার জাল বিছিয়ে তার উপর রোগীকে বসানো হয়। পরে একই জাল দিয়ে আক্রান্ত লোকটিকে ঢেকে তারপর পানিপরা পানি দিয়ে স্নান করিয়ে তৈলপরা তৈল দিয়ে মালিশ দেওয়া হয়।
শোনা যায়, কোন কোন কবিরাজ শুকনো মরিচ পুড়িয়ে রোগীর নাকের মধ্যে ধরে মন্দ আত্মাকে রোগীর মাধ্যমে জবাবদিহি দিতে বাধ্য করা হতো। এই পদ্ধতিতেই মন্দ আত্মার কাছেই জেনে নেওয়া হতো, চিকিৎসার উপায়।
ঙ) সিম্মা নিয়া (রোগ নির্ণয়) এবং আমুয়া
গারো ভাষায় সিম্মা নিয়া মানে হচ্ছে রোগ নির্ণয়। এই পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়ের জন্য বাঁশের কাঠি এবং অনেকগুলো সুতা দিয়ে তৈরী একটি জিনিস থাকে, যাকে গারো ভাষায় ফংসি বলা হয়।
সাংসারেক ধর্মের দেবদেবীদের উদ্দেশে গারোভাষায় মন্ত্রপাঠ করে রোগ নির্ণয় করেন এবং এর নিরাময়ের উপায় সম্পর্কে জেনে থাকেন। প্রক্রিয়াটি খুব অদ্ভুদ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন দেবতাকে কি কি নৈবেদ্য দিয়ে পুজা দিতে হবে, সেটিও এই সিম্মা নিয়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রোগের চিকিৎসা হিসাবে দেবদেবীর পূজা সম্পর্কে জানতে … অধ্যায় সাংসারেক ধর্মাবলম্বীদের কয়েকটি পূজার নিয়ম”লেখাটি পড়ুন।
সিম্মা নিয়ার মন্ত্র এরকম-
আমা ফিলদিনি গুয়াসি ওয়াচিং রাম্মানা
চেংখিনা জাগাং সাল্লানা, চুরাম চুসুম্মুদ্দানা
ওয়াচি রংকুরাক্কানা।
গুবারি রোঙা চেকিনারি রান্নারিঙা
আমা ফিলদিনি গুয়াসি ওয়াচিং রাম্মানা
চেংখিনা জাগ্রা সাল্লানা, চুরাম চুসুম্মুদ্দানা
ওয়াসি রংকুরাক্কানা,
ওয়াতনাংচি জেঙাত মেচিকবা,
গুবারি রোঙা সিক্কেনারি জান্নারিঙা
হুখো খিন্নাসিংসাঙে নিকজা গিরঙে
পাত্তাল রিংরাপনি সিল্লাং খুটিনি
গুয়াংফা সিংরিফাবা- উখো রাবাআয় সিংও,
খিবায় খিলদিং দকজি বিমাখো
সিপফোক জাসেঙা …
নুরুনা আগানিংজক, মান্দিনা খুসকগিংজক
আমা ফিলদিনি গুয়াসি ওয়াচিং রাম্মানা
চেংখিনা জাগাং সাল্লানা, চুরাম চুসুম্মুদ্দানা
ওয়াচি রংকুরাক্কানা, গুবারি হংজানোয়া সিক্কেনারি হংজানোয়া
জাককো গারিনোয়া, থেত্তো দিংরাকখারিনোয়া
খিমদত্তারি রাংবো, সিসেত্তারি সকখাংবো, বোংফাচা রিয়াংবো
দতমিফাচা সকখাংবো, বোংফাদে দানিং দতমিফাদে দানিং
বিনি খাচারি বিনি বান্দাসালো
ফ্রাফ দকজি বিমাও গাসাং রিঙারি, বালওয়া রিঙারি
হুছাহা রোঙা, উছাহা দিঙা…।
আমিকানি জাঙ্গিনা, আমিকানি জামানা
মিদ্দি মান্দি সিক্কামা… (অনুমানকৃত দেবতার নাম এবং রোগের নাম বলতে থাকবে)
তারপর, ফংসির নড়াচড়া দেখে রোগের নাম অথবা রোগের বর্ণনা খামাল বুঝতে পারেন।
উপসংহার
উপরোক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ছাড়া গারোরা আধুনিক এলোপ্যাথিক ডাক্তার, হোমিও ঔষধগুলো ব্যবহার করে আসছে। তবে, অন্যান্য আদিবাসীদের মতো আদিথেকে এখন পর্যন্ত গ্রাম্য কবিরাজ এবং বিভিন্ন লতাপাতা, শিকড়বাকড় দিয়ে তৈরী ঔষধগুলোও ব্যবহার করে থাকে। পরবর্তী অধ্যায়ে তা বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।