সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ব্লগসপ্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারো শহীদ - জুন ২৮, ১৯১৪- নভেম্বর ১১, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারো শহীদ – জুন ২৮, ১৯১৪- নভেম্বর ১১, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ

বংলাদেশে কয়েকজন গারো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শহীদের নাম জানা যায়। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসন থেকে এই বাংলাকে মুক্ত করতে এ বীর সেনারা সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই এই বাংলার মানুষ অর্জন করেছে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে যে ক’জন গারো মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন- হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) উপজেলার বাঘাইতলা গ্রামের শহীদ আরং রিছিল, মনিকুড়া গ্রামের শহীদ পরিমল দ্রং, ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ি গ্রামের শহীদ অনীল সাংমা প্রমূখ।

এছাড়াও আরো একজন গারো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম শোনা যায়, তিনি হলেন জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার দিগলাকোনা গ্রামের শহীদ সম্রাট দালবত (সূত্রঃ শফিউদ্দিন তালুকদার, বাংলাদেশের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা পৃ-২৯; প্রকাশ-২০১০,২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ)।

কোন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, দেশ মাতৃকার স্বাধিনকল্পে গারোদের বীরত্বগাথা শুধুমাত্র বাংলাদেশ বা ভারতের মাটিতে নয়; বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রয়েছে এমন বীরত্বগাথা। সুদূর ফ্রান্সের মাটিকেও সিক্ত করেছে গারো জাতিসত্ত্বার মানুষ; এ কথা আমরা হয়তো অনেকেই জানি, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানে না, জানার সুযোগও হয়তো পাচ্ছে না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারো শহীদ

অতীতে গারোদের মধ্যে হয়তো অনেকেই ফ্রান্স গেছেন অথবা অদূর ভবিষ্যতে যাবেন। ফ্রান্সে যাওয়ার সুযোগ হলে অনুগ্রহ করে, গারো জাতিসত্তাকে ভালোবেসে এবং সম্মান প্রদর্শণ পূর্বক অন্তত একবার ফ্রান্সের পেরণ (Péron), আমিয়া (Amia) এবং লংগো (Longou) ঘুরে আসুন আর দেখে আসুন যেখানে গভীর সম্মান নিয়ে শায়িত রয়েছে ৫৫জন গারো বীরপুরুষ।

লেখক লুই সাংমা বর্তমানে ফ্রান্সে অবস্থানকালে এ গ্রন্থে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারোদের অংশগ্রহণ সম্পর্কীত বিষয়টি তুলে ধরার উদ্দেশে উক্ত কবরগুলো পরিদর্শন করেছেন।

সুদূর ফ্রান্সের মাটিতে গারোদের কবরে নামের সাথে সাংমা, মারাক, মোমিন, আরেং টাইটেলগুলো দেখে এবং তাঁদের বীরত্বের ইতিহাস পড়ে লেখক লুই সাংমার মতো যে কেউই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়বেন; তেমনই গারো, সকলেই নিজ জাতিকে নিয়ে গর্ববোধ করবেন- এটাই স্বাভাবিক।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, আজ থেকে ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৭ খ্রি.) ৬৯ ব্যাচে শ্রমিক কর্পোরেশন কর্তৃক ভারতের পাঁচশত (৫০০) জন গারো পুরুষকে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছিলো।

নিয়োগ প্রদানের উদ্দেশ্য ছিলো ফ্রান্সের প্রত্যন্ত রাজ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগের রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণে সাহায্য করা এবং যুদ্ধাস্ত্র, খাদ্য ও অন্যান্য সরকারি পণ্য পৌঁছিয়ে দেওয়ার কাজে এদের ব্যবহার করা। কিন্ত এঁদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা হলেও তাঁরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং এই ৫০০ জনে মধ্যে মাত্র ১২০ জন স্বদেশে প্রাণ নিয়ে ফিরতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে, দফায় দফায় ব্রিটিশ বিরোধী গারো আন্দোলনে অতিষ্ট ব্রিটিশ সরকার জানতো যে- জাতিগতভাবেই গারোরা প্রচণ্ড সাহসী, জেদী, বলশালী এবং মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত এই জাতি। বৃটিশ সরকার ১২ এপ্রিল, ১৭১৭ তারিখে এক প্রজ্ঞাপন জারীতে বলা হয়, ইউরোপে ২০০০ হাজার গারো পুরুষদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। প্রজ্ঞাপনে এও বলা হয়েছিল, রাজ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগ, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণে সহায্য করা। কিন্ত নিয়োগের পর বলা হয়, শ্রমিকদেরকে ইউরোপে যুদ্ধে জার্মানদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের লড়াকু সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য যেতে হবে। তবে শর্ত দেয়া হয়, তাঁদেরকে সম্মুখ সমরে যেতে হবে না, তাঁদের সৈনিকদের পেছনে থেকে সহযোগিতা করতে হবে এবং এর বিনিময়ে আকর্ষণীয় সম্মানি প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে ভারতের ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ ড. মিল্টন এস. সাংমা তাঁর “The First World War and The Garo Labour Corps” (প্রকাশকালঃ জুলাই, ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রন্থে বলেছেন, “Recruitments to the 69th Garo Labour corps were done in three centres at Damra in the north, Baghmara in the south and at Tura, during the months of April and May 1917 totalling more than one thousand men. All these recruits were assembled and camped at Tura, than accommodated in the American Baptist Mission Compound in the Hostels and Dormitories through the enthusiastic favour of Rev. F,W Harding. This is clear from the letter of the Assam Government and the Chief Commissioner… (Reference: page 05, 06)”। সে অনুযায়ী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ১৮-৩৫ বছর বয়সী সুঠাম ও শক্তিশালী ১০০০ (এক হাজার) গারো পুরুষদেরকে বাছাই করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের তুরা ক্যাম্পে রেখে প্রায় একমাস প্রশিক্ষণ প্রদানের পর এঁদের মধ্য থেকে ৫০০ (পাঁচশত) জন গারো পুরুষকে ফ্রান্সে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। সূত্র মতে, ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট তারিখে অন্যান্য ভারতীয় নাগরিকদের সাথে এই দল ফ্রান্সে উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। এই দল কোলকাতায় এক মাস অবস্থান করার পর ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে গিয়ে পৌঁছেন ১৯ অক্টোবর। উল্লেখ্য এই ৫০০ জন গারো শ্রমিককে পাঠানো হলেও শেষ পর্য়ন্ত ফ্রান্সে মাত্র ৪৫৬ জনের উপস্থিতি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো বলে জানা যায়। এই ৪৫৬ জনের দলকে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে ফ্রান্সের বিভিন্ন রাজ্যে, যেমন- পুঁইসিউ (Puisieux), বক্যোয়া (Bocquoy), ল্যা চ্যাপ্লেট (La Chappellette), ব্রুল (Brusle) ইত্যাদি শহরসমূহে বিভিন্ন দায়িত্ব দেয়া হয়। উক্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই শ্রমিকদের দায়িত্ব ছিলো, কাঠ উঠানো নামানো, ক্যাম্প প্রস্তুত করা, পরিখা খনন করা এবং শত্রুদের গতিপথে ব্যারিকেট তৈরী করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গারো শ্রমিকরা দায়িত্ব পালন শেষে ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ জুলাই ফ্রান্সের বন্দর নগরী মার্শাই থেকে স্বদেশ ভারতে ফিরেন মাত্র ১২০ জন। ড. মিল্টন এস. সাংমা রেফারেন্স দিয়ে উক্ত গ্রন্থে লিখেছেন “Only 120 men actually came at Tura. While They were still camping at Tura, one man died, one at Garden Reach, Calcutta, one board the ship at Alexandria and 55 men in France (reference: Garo Readers IV, published Tura Book Room, page 77).”।

পূর্বেই বলা হয়েছে ৫০০জন গারো শ্রমিককে পাঠানো হলেও ফ্রান্সে মাত্র ৪৫৬ জনের উপস্থিতি লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ৫০০ জনের মধ্য থেকে যাত্রার শুরুতে কারন ও স্থান উল্লেখ করে মাত্র ৩ জন মৃত্যুবরণ করেছেন বলে স্বীকার করা হয়েছে। এবার আরেকটু গভীরে খেয়াল করার বিষয় আছে, ফ্রান্সে যাত্রা শুরু করেছে মোট ৫০০ জন, আর যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরেছেন মাত্র ১২০জন এবং ফ্রান্সে মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৫ জন। চলুন এবার তাহলে যথারীতি অংকই কষা যাক, মোট শ্রমিক সংখ্যা ৫০০জন, সেখান থেকে মোট মৃত্যু বাদ দিলে ৪৪২জন জীবিত ফেরার কথা; কিন্তু বাস্তবে ফিরেছেন মাত্র ১২০ জন গারো শ্রমিক। অর্থাৎ এহেন ২৭৮জন গারোর তথ্য পাওয়া গেলেও বাদবাকী (৪৪২-১২০)= ৩২২জন গারো শ্রমিকের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আজও অজানা ইতিহাস রয়েই গেল।

ড. মিল্টন এস. সাংমার ‘The First World War and The Garo Labour Corps’ গ্রন্থে এবং মেঘালয়ের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বলা আছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সে ৫৫জন গারো বীর শহীদের কবর যথাযোগ্য মর্য়াদায় রাখা হয়েছে। মেঘালয়ের তুরা স্মৃতিস্তম্ভেও এই ৫৫জন গারো বীর শহীদের তালিকা রয়েছে। সেই তালিকা থেকে প্রাপ্ত শহীদদের নাম নিম্নে দেয়া হলো-

১। নাজক সাংমা (Najok Sangma)

২। মানদিং মারাক (Manding Marak)

৩। ছাকরং মারাক (Chakrang Marak)

৪। জিংজা সাংমা (Jingja Sangma)

৫। খিউ মারাক (Khew Marak)

৬। রাচান সাংমা (Rachan Sangma)

৭। থরিন সাংমা (Thorin Sangma)

৮। তিলক সাংমা (Tilok Sangma)

৯। বাঙ্গালসিং গারো (Bangalsing Garo)

১০। গরান সাংমা (Goran Sangma)

১১। মনসি মমিন (Monsi Momin)

১২। মহান মারাক (Mohan Marak)

১৩। জয়েন মারাক (Join Marak)

১৪। ‍সন্না সাংমা (Sonna Sangma)

১৫। উসানসিং সাংমা (Ushansing Sangma)

১৬। জিন্না সাংমা (Jinna Sangma)

১৭। থেজাং সাংমা (Thejang Sangma)

১৮। থিজান মারাক (Thejan Marak)

১৯। ছেংগ্রান (Changran Sangma)

২০। রিংসা সাংমা (Ringsa Sangma)

২১। ওয়াজান সাংমা (Wajan Sangma)

২২। থিয়ান সাংমা (Tian Sangma)

২৩। পছিন্দ্র মারাক (Puchindra Marak)

২৪। বারন মারাক (Baron Marak)

২৫। ‍আদিং সাংমা (Ading Sangma)

২৬। ‍সাংগিন মমিন (Sangin Momin)

২৭। জাকমান সাংমা (Jakman Sangma)

২৮। রমান মারাক (Raman Marak)

২৯। খিনজাং মারাক (Khinjang Marak)

৩০। রিংজান সাংমা (Ringjang Sangma)

৩১। খুমান সাংমা (Khuman Sangma)

৩২। খামিন সাংমা (Khamin Sangma)

৩৩। রাখিন মারাক (Rakhin Marak)

৩৪। জিতা আরেং (Jita Areng)

৩৫। পদারসিং সাংমা (Podarsing Sangma)

৩৬। দমা মমিন (Doma Momin)

৩৭। বিতাল মমিন (Bital Momin)

৩৮। আবিং সাংমা (Abing Sangma)

৩৯। আমারসিং সাংমা (Amarsing Sangma)

৪০। মাদু গারো (Mado Garo)

৪১। গেন্নিং মারাক (Genning Marak)

৪২। সিঙ্গারা মারাক (Singara Marak)

৪৩। জিসাং সাংমা (Jesang Sangma)

৪৪। শলামান সাংমা (Solaman Sangma)

৪৫। খমপেঙ গারো (Khompeng Garo)

৪৬। জানতারান মারাক (Jantaran Marak)

৪৭। ঐজান মারাক (Oijan Marak)

৪৮। সিঙ্গা সাংমা (Singa Sangma)

৪৯। গাজাং সাংমা (Gajang Sangma)

৫০। ‍শিবনাথ মারাক (Sibonath Marak)

৫১। আদিং সাংমা (Ading Sangma)

৫২। মানজিং সাংমা (Manjing Sangma)

৫৩। জেমিং মারাক (Jeming Marak)

৫৪। সাঙ্গিন সাংমা (Sanggin Sangma)

৫৫। সাইমন সাংমা (Simon Sangma)

ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শহীদ গারো এবং বীরদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতি বছর ১৬ জুলাই ‘The First World War and The Garo Labour Corps’ উদযাপন করে আসছে। গ্রন্থটিতে সংক্ষিপ্তাকারে বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় গারোদের অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধে শহীদ সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি আমরা; এবং সত্যিই গর্বের বিষয় এবং ইতিহাসে তাঁদের অবদান ভুলবার নয়।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য