এই আর্টিকেলে গারো বর্ণমালা আবিষ্কার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ।
প্রাকৃতিক নিয়মে সময় দ্রুতই বদলায়, প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনধারা, সমাজ ও সংস্কৃতি। একজন ব্যক্তিকে যা পরিচিতি করে তোলে তাহলো দৈহিক গঠন, জীবনাচরণ, সংস্কৃতি ও ভাষা।
যার কিছু অংশ হয়তো মানুষের চোখে দৃশ্যমান; আবার কোনটা নয়। সমস্তকিছুর পরিবর্তনের একটা ধারা থাকে, কিন্তু এই ধারা যদি নিয়ন্ত্রণহীন গতিবেগে ছুটতে থাকে, তাহলেই বিপত্তি।
বিশ্বায়নের ফলে, সমাজ, সংস্কৃতি, মানুষের আচার আচরণ, যে গতিতে পরিবর্তিত, তেমনই পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের ভাষা। ইউনেস্কোর মতে, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৬৭০০টি ভাষা রয়েছে, এ হিসাবে আদিবাসীদের বা সংখ্যালঘুদের ভাষাই বেশি।
কিন্তু উদ্বেগজনক তথ্য যে, সাম্প্রতিকালে পৃথিবী থেকে প্রায় ২২৯টি ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেছে, এবং ২৫৮০টি ভাষা হারানোর পথে। ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভাষাগুলো অপসংস্কৃতায়নের ফলে, সংখ্যাগুরুর ভাষার চাপে এবং নিজস্ব ভাষাগুলো অবজ্ঞা অথবা অব্যবহৃত ভাষাগুলো বিপন্ন এবং বিলুপ্তির পথে।
গারো বর্ণমালা আবিষ্কার
আমাদের আলোচ্য বিষয় গারোদের মাতৃভাষা নিয়ে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গারোদের ১৭টি গোত্র রয়েছে এবং প্রায় সব গোত্রের নিজস্ব ভাষা রয়েছে বা ছিলো। কিন্তু গারো গবেষকদের তথ্যমতে মাত্র ৭টি গোত্রের ভাষা চলমান রয়েছে। তাহলে, আর বাকী ১০টি গোত্রের ভাষা কোথায় হারিয়ে গেছে ?
নাকি, ঐ ৭ গোত্রের ভাষার সাথে মিলিয়ে গেছে ? হতেও পারে। গারো সমাজ চিন্তাবিদদের ধারণা, যে পরিমান গারোদের ভাষা টিকে রয়েছে, তাও বিলুপ্তির ঝুকি অনেক বেশি রয়েছে।
একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে একটি সংস্কৃতি, একটি সভ্যতার নিদর্শণের বিলুপ্তি। ইউনেস্কো বলছে, প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে এবং এভাবে ২১০০ শতাব্দীর মধ্যে বর্তমানের অর্ধেক ভাষাই হারিয়ে যাবে। এই ধারায় গারোদের অবশিষ্ট ৭টি ভাষাও পড়েনিতো ?
এমনটি হলে, গারো ভাষাভাষীদের জন্যেও ভয়ঙ্কর উদ্বেগের, হতাশার।
হরফ এর ব্যবহার
প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠির পরিচয় হলো তার নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভাষা। সংস্কৃতির প্রধান উপাদানই হলো ভাষা এবং বর্ণমালা। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ৪৫টি আদিবাসী সমাজে নিজস্ব মাতৃভাষার মৌখিক চর্চা থাকলেও অধিকাংশ ভাষার নিজস্ব লিপি না থাকায় অনেকেই বাংলা অথবা রোমান হরফ ব্যবহার করে ভাষাচর্চা করে থাকেন।
চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা মৈতৈ মণিপুরিরা নিজস্ব বর্ণমালা তৈরী করে নিজেদেরে ভেতর মাতৃভাষা চর্চা করেন।
বর্ণমালা
গারোরাও চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরাদের সমপর্যায়ের। গারোদের গোত্রগত ভাষার সংখ্যাও বেশি, তারপরেও একটিরও বর্ণমালা নেই কেন?
প্রশ্নটা গারোদেরও, কিন্তু এর সদুত্তর কে দেবে ?
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে- গারোদের আচিক বা আবেং ভাষা ব্যবহারের নিমিত্তে পাঁচ ধরনের আচিক থকবিরিম (বর্ণমালা) প্রস্তাবিত হলেও তা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
জনশ্রুতি আছে, সম্ভবত সত্তরের দশকে সর্বপ্রথম গারো বর্ণমালা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন প্রয়াত জন থুসিন রিছিল। পরবর্তীতে ডানিয়েল রুরাম, মার্টিন রেমা, প্রদীপ মানখিন এবং অরুণ রিছিল প্রমুখ।
বর্ণমালার ডিজাইন
বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির মুখপত্রের সূত্রমতে, বিভিন্ন সময়ে প্রয়াত বিধি পিটার দাংগো, জন থুসিন রিছিল, ডানিয়েল রুরাম, মার্টিন রেমা প্রমূখ সকলেই ভিন্ন ভিন্ন আকৃতিতে গারো ভাষার বর্ণমালার ডিজাইন করেছিলেন।
এছাড়াও প্রকাশিতব্য গ্রন্থটির চুরান্ত প্রস্তুতিকালে আরো দুজন তরুণ গারো লিপি উদ্ভাবকের নাম আমরা জানতে পারি। তাঁরা হলেন ম্যাগনেট জাম্বিল, যিনি এখন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে বর্তমানে আষ্ট্রেলিয়াতে অবস্থান করছেন এবং প্রিন্সন সাংমা।
প্রতীক, মোট ধ্বনি
প্রিন্সন সাংমার উদ্ভাবিত বর্ণমালার নাম দিয়েছেন আ.চিক বিরঙ (A.chik Birong)। গারো তরুণ বর্ণমালা উদ্ভাবক প্রিন্সন সাংমা তিনি তাঁর উদ্ভাবনী লিপির স্বপক্ষে যুক্তি এবং বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন।
মূলত আ.চিক বিরঙ বর্ণ বা প্রতীক রয়েছে ২৫টি, ধ্বনি রয়েছে মোট ২৯টি, ৭টি ধ্বনি লুকোনো রয়েছে এবং এর মধ্যে দুটি ধ্বনি ঐচ্ছিক বলে জানান। অর্থাৎ তিনি জানান আ.চিক বিরঙ একটি লিখন পদ্ধতি এবং এর গঠন তুলনামূলক কম আয়তাকার, লতাকৃতি, অর্ধবৃত্ত, অর্থবোধক, পরিমার্জিত, লিখতে সহজ এবং সুন্দর।
বৈশিষ্টের বিচারে বর্ণমালাটি তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, রঙ.বিমা (১৬টি), রঙমা.রাপ (৬টি), রঙ.বিস্রি (৩টি)। ১৯৯৩ সালে বর্ণমালাটি আবিস্কার করলেও নানা প্রতিবন্ধকতা এবং পৃষ্টপোকষতার অভাবে উদ্ভাবিত বর্ণমালাটিও এখনো আলোর মুখ দেখেনি ।
গারো ভাষাকে লেখ্যরুপ
এ পর্যন্ত মোট অন্তত ৭জন গারো নিজেদের ব্যবহৃত গারো ভাষাকে লেখ্যরুপ দেয়ার নিম্মিত্তে বর্ণমালা উদ্ভাবন করলেও উপরোক্ত দুটি বর্ণমালার চিত্র থেকে বোঝা যায়, কারোর বর্ণমালার সাথে কারোর বর্ণমালার তেমন কোন মিল নেই এবং অমিল থাকাও স্বাভাবিক।
কিন্ত উক্ত উদ্ভাবিত বর্ণমালাসমূহকে ব্যাকরণিক প্রয়োগ, বিধি, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ অপর্যাপ্ততা রয়েছে- এ অজুহাতে উক্ত বর্ণমালাগুলো আলোর মুখ দেখেনি অদ্যাবধি। তবে, জনশ্রুতি অনুসারে- অনেকেই তাঁদের উদ্ভাবিত বর্ণমালার সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে নেত্রকোনার বিরিশিরিতে গারোদের জন্য নির্মিত একমাত্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি-তে জমা দিয়েছিলেন।
কালচারাল একাডেমি উদ্যোগ
এক্ষেত্রে কালচারাল একাডেমি বরাবরই নীরব থেকেছে কেন, তা নিয়ে মাঝে মাঝে জনগণের মনে প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু এর উত্তর কেউ পেয়েছেন কিনা সেটা প্রশ্নকারীরাই ভালো বুঝবেন। আমরা এই গ্রন্থের মাধ্যমে প্রস্তাব রাখতে চাই, কালচারাল একাডেমি উদ্যোগ নিয়ে গারোদের সকল গোত্রের প্রতিনিধির সমন্বয়ে জমাকৃত সমস্ত বর্ণমালা থেকে বাছাই করার জন্য একটি কমিটি করা হোক।
উদ্ভাবিত বর্ণমালাগুলো কমিটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাচাই বাছাই বা সম্পাদনের করে কালচারাল একাডেমি কাছে জমা দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক। পরবর্তী প্রয়োজনীয় কর্ম সম্পাদন সুষ্ঠুভাবে হলেই গারোরাও ভাষার বর্ণমালা পেয়ে যেতে পারেন।
উপসংসার
যে কোন জাতিগোষ্ঠির লিপি বা বর্ণমালা সম্পর্কিত কথা বলার অর্থই হলো- ভাষার দাবী, সবার প্রাণের দাবী। গারো ভাষা মুখে বলা গেলেও লিখতে গেলে জটিলতায় পড়তে হয়। সাধারণত রোমান হরফ অথবা বাংলায় লিখতে গেলেও ব্যাকরণগত সংশয় থেকে যায়।
নতুন প্রজন্ম এবং গারো ভাষা টেকসই করণার্থে আবিষ্কৃত বর্ণমালাগুলো নিয়ে গ্রহণযোগ্য এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহারে গারো গবেষকদের ওপর সময়ের দাবী। ফলোশ্রুতিতে একটি বর্ণমালা পরিমার্জিত, পরিশোধিত ও উন্নত সংস্করণ গবেষণা তত্ত্ব সমেত সর্বসাধারনের জন্য উম্মুক্ত করা হলেই হতে পারে গারো বর্ণমালা সংকটের সমাধান।
লুই সাংমা
লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মী