সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ব্লগসগারো খাবার ও পোষাকগারো চু এর ব্যবহার | গারোদের পবিত্র পানীয়

গারো চু এর ব্যবহার | গারোদের পবিত্র পানীয়

চু হলো গারো সমাজের পবিত্রতার প্রতীক । রোগ প্রতিরোধ বা প্রতিকার থেকে শুরু করে গারো চু এর নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে । এই আর্টিকেল সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ।

গারো চু এর নানাবিধ ব্যবহার গুলো:

১) শিশুর জন্মে :

আগেই বলা হয়েছে- আদিগারোদের বিশ্বাস অনুসারে চু পবিত্রতার প্রতীক। গর্ভধারন নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে গারোরা শিশুর নামে চুজাঙ্গি (অর্থাৎ জীবনপানীয়) প্রস্তুত করে।

সামর্থ অনুসারে সবচেয়ে বড় দিকথম বা দিকখাতে (মাটির পাত্র) এই চুজাঙ্গি প্রস্তুত করা হয়। শিশু ভুমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে পাত্র থেকে এক ফোটা বিচ্চি (আসল রস) শিশুর মুখে বা জিহ্বায় লাগিয়ে দেওয়া হয়। খামাল দীনেশ নকরেকের ভাষ্যমতে, খ্রিষ্টানদের বাপ্তিষ্ম বা মুসলমানদের সুন্নত করার মত এটি গারোত্ব বরণ করার একটি আদিপ্রক্রিয়া। শিশুর মাকে এবং ধাত্রীদেরকেও এই চু খাওয়ানো হয়।

প্রবীণদের ধারণা, এই চু পান করলে প্রসূতির ব্যাথা লাঘব হয়। প্রক্রিয়াটি সাংসারেক ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলন থাকলেও বর্তমানকালে গারো খ্রিষ্টানদের মধ্যে শিশুকে চু খাওয়ানোর প্রচলন দেখা যায় না।

২) অতিথি আপ্যায়নে :

এই চু-এর যে কোন ধরণের বৈঠকের সময় যেমন- পারিবারিক বা সামাজিক বৈঠক, বিবাহ, শ্রাদ্ধ, বিচার ইত্যাদিতে আগতদের জন্য এই চু পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও প্রত্যেকটি পরিবার চ্রা, নকচিক এবং যে কোন অতিথির সম্মানে এই চু পরিবেশন করার রেওয়াজ এখনও প্রচলিত।

৩) মৃত দেহ স্নানে :

মৃতকে দাহ বা কবরস্থ করার আগে চু বিচ্চি দিয়ে লাশ ধোয়ানো এবং কবর বা চিতার চারপাশে ঘুরে চুবিচ্চি ছিটিয়ে শুচিকরণ সাংসারেকদের অত্যাবশ্যকীয় কর্ম। গারোদের আদিধর্ম সাংসারেকদের মৃতদের সৎকার এ পদ্ধতিতেই করে থাকে; তবে খ্রিষ্টানরা পুরোহিতের আশীর্বাদকৃত পবিত্র জল দিয়ে শুচি কর্ম সম্পাদন করে থাকে।

৪) উৎসবে :

গারোদের যেকোন উৎসবে চু ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়। যেমন- বিবাহের প্রস্তুতিতে, বিবাহ অনুষ্ঠানে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে গিম্মিন বা গুম্মুন নেওয়ার সময় দিকখা (বড় হাড়িতে তৈরী চু) নিয়ে যেতে হতো। আধুনিককালে কিছু প্রটেস্টান মণ্ডলীর লোকেরা চু ব্যবহার করেন না।

৫)পুজাবলিতে :

গারো সাংসারেক ধর্মানুসারিদের বিশ্বাস মতে, চু বা চুমান্থি দেবতার দান। সুতরাং যেহেতু আদি গারো বা সাংসারেকদের কাছে চু পবিত্রতার প্রতীক; তাই সাংসারেকদের প্রত্যেকটি দেবতার পূজা এবং পশু বা পাখি বলির সময় চুবিচ্ছি বা চেকগা উৎসর্গ করতে হয়।

৬) রোগ প্রতিরোধ বা প্রতিকার হিসাবে :

আদিগারোদের বিশ্বাস অনুসারে চু যেমন পবিত্রতার প্রতীক, তেমনই এটি ভালো দাওয়াই। সর্দি, কাশি, পেটের পীড়া, আমাশয়, বহুমূত্র, বিষাক্ত পোকার আক্রমণে, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, ধাতু দুর্বলতা বা সহবাসে অক্ষম ইত্যাদি রোগে প্রতিষেধক ও প্রতিকারের মহৌষধ হিসাবে ব্যবহার হতো। শরীরে কেটে গেলে রক্ত বন্ধ করতে এবং ব্যাথা কমাতেও ক্ষততে চুবিচ্চি দেওয়া হয়।

৭) তথ্য আদায়ে :

অতিরিক্ত চু খেলে যেহেতু নেশা হয়, তাই উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছথেকে কোন তথ্য আদায়, দোষ স্বীকার করানোর সময় কৌশলে খাইয়ে আসল তথ্য আদায় করা হতো। গারোদের বিশ্বাস, চু পান করলে কেউ চালাকী অথবা কোন তথ্য গোপন রাখতে পারে না। শুধু তাই নয়, আদিকালে বিবাহের প্রস্তাবে রাজী না হলেও ছেলেকে খাইয়ে নেশার ঘোরে রাজী করানো হতো বা যুবতীর ঘরে থাকতে বাধ্য করা হতো (দ্রষ্টব্য-চামে জি.কা, পৃষ্ঠা নং …)

৮) সমস্যা সমাধানে বা কর্ম সম্পাদনে :

পরিবার বা সমাজের যে কোন ধরণের বড় কাজে লোকজনকে অংশগ্রহণ (এলাকাভেদে এ পদ্ধতির বিভিন্ন নাম; যেমন- রিমগ্রিমা, বারাগ্রিকা, মাংনা কামলা ইত্যাদি) করিয়ে অল্প সময়ে কাজ সম্পন্ন করার উপায় এই চু। একবেলা ভাতের সাথে চু খাওয়ালেই সকলে মিলে খুশিমনে কাজগুলো করে দিতো।

৯) শত্রু দমনে :

চু-এর স্বাদ এবং গন্ধে আকৃষ্ট হয় এমন কিছু কিছু পোকামাকড় রয়েছে। এগুলোকে ধরার ফাদ হিসাবে চু ফেলে রাখা হতো, ওগুলো খেয়ে বা গন্ধে নেশাগ্রস্ত হলে সেগুলো মেরে ফেলার ভালো উপায় হিসাবে চু ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্যদিকে ক্রোধ বশতঃ শত্রুকে ঘায়েল করতে অথবা চু এর সাথে আরাগিত্থাং বা আরাগিসি খাওয়ানো হতো।

১০) ক্লান্তি ও অবসরে :

কঠিন কাজে শক্তি যোগাতে বা কাজের ফাঁকে, বিশ্রামে শরবতের বিকল্প হিসাবে চু-এর ব্যবহার এখনও পরিলক্ষিত হয়। পরিবারে বা পাড়ায় সন্ধ্যায় বা অবসরে সকলে মিলে সময় কাটানোর উত্তম উপায় হলো একটা চু-দিকখা। অতীতে বন্যজন্তু শিকারে শক্তিবর্ধক হিসাবে চুবিচ্চি পান করা হতো।

 ১১) সম্মান ও সুনাম বাড়াতে :

যে যত বড় দিকথম বা দিকখায় চু প্রস্তুত করবে এবং যত বেশি চু-এর বয়স হবে, সে অনুসারে তার সুনামও বৃদ্ধি পাবে। সেসাথে যার চুএর স্বাদ এবং গন্ধ ভালো হবে, চু-এর প্রস্তুতকারিনীও তত বেশি প্রশংসার দাবীদার।

১২) নেশা হিসাবে :

চা-পানে আসক্ত ব্যক্তিরা যেমন চা-পান ছাড়া থাকতে পারে না, যারা চুকে নেশা হিসাবে পান করে- তাদের অবস্থাও এমনই। বিভিন্ন কারণে দুশ্চিন্তা, কষ্ট-দুঃখ ভুলে থাকার জন্য চু নেশা হিসাবে গ্রহণ করে থাকে।  যাদের ঘুম কম হয় তারাও এই চু পান করে থাকে।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য