সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
প্রচ্ছদগারো ইতিহাস ও ঐতিহ্যগারোদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভৌগোলিক অবস্থান অতীত ও বর্তমান

গারোদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভৌগোলিক অবস্থান অতীত ও বর্তমান

বিচিত্র এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড এবং এর পরিবেশ। বৈচিত্রময় বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের প্রানীকুলের মাঝে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ; এবং এ মানবকুলের জাতি ও প্রকৃতিও বৈচিত্র্যময়। গারোদের জনগোষ্ঠীর পরিচয় অনেক বৈচিত্রময় । এই আর্টিকেল আপনি জানতে চলেছেন, গারোদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভৌগোলিক অবস্থান এর অতীত ও বর্তমান অবস্থান ।

গারোদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও বিস্তারিত বর্ণনা

একটা সময় ছিলো, যখন আদিবাসীদের জীবন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। গহীন বনের বাসিন্দা। বনের ফলমূল, লতাপাতা খেয়ে দিনাতিপাত করতো; রোগে শোকে মৃত্যু যন্ত্রাণায় কাতরাতে কাতরাতে জীবনাবসান হতো।

কালের বিবর্তনে এসব মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে, কেউ কেউ আলোতে ফিরে এসেছে। বিভিন্ন জাতি, বর্ণে পরিণত হয়েছে; তেমনই ভাষারও পরিবর্তন হয়েছে।

এই বিবর্তনের ফলে গারোদের দৈনন্দিন পোষাক-পরিছদ, চলন-বলন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, খাদ্যাভাস, রন্ধন প্রক্রিয়াসহ তাঁদের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, জীবন জীবিকা এবং পেশা ইত্যাদিও যথেষ্ট বৈচিত্র এসেছে।

এমনই এক জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে আমরা আলোকপাত করতে যাচ্ছি, সে জাতির নাম গারো বা মান্দি জাতি। এই জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে গর্ব করার মতো নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং নিজস্ব ভাষা।

মান্দি (Mandi) শব্দের বিশ্লেষণ

মান্দি (Mandi) শব্দের আক্ষরিক অর্থ মানুষ। ইংরেজীতে বললে এমন দাঁড়ায় Mandi means men or women, a human being; আর অন্যটি হলো আচিক (A.chik); বাংলা অর্থ, একটি পাহাড়, একটি সেতুবন্ধ, একটি ঢিপি, একটি গারো মানুষ ইত্যাদি বুঝায়। যার ইংরেজী অর্থ এমন a hill, a ridge, a hillock, a Garo man ইত্যাদি বুঝায়।

আসলে শব্দ দুটিকে অঞ্চলভেদে বা গোত্রভেদে বিভিন্ন নামে উপস্থাপন করতে স্বাছন্দবোধ করে। অঞ্চলভেদে কেউবা বলে মান্দি, গারো, আচিক বলে সম্বোধন করে থাকেন। লোকালয়ে মান্দিদের গারো বা আচিক/পাহাড়ী নামেই অধিক পরিচিত। বর্তমানে সচেতন গারোরা নিজেদের আচিক বা গারো আদিবাসী বলে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে।

আচিক বা মান্দি/মান্দে শব্দের অর্থ পাহাড়ি মানুষ। উপজাতি শব্দটি বাঙালীদের দেয়া। যদিও এদেশের সরকারী দাপ্তরিক ভাষায় এই জনগোষ্ঠিকে আদিবাসী শব্দের স্থলে নৃ-গোষ্ঠি, ক্ষুদ্র জাতি অথবা উপজাতি অভিহিত করে থাকেন।

গারোদের পরিচয় জানার আগে মনুষ্য জাতি বা নৃ-জাতি সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানের সংজ্ঞা খুব সংক্ষিপ্তাকারে আলোকপাত করা যাক। নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন দৈহিক বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নৃ-গোষ্ঠীর শ্রেণী বিভাগ করা হয়। দৈহিক বৈশিষ্টগুলো হলো- মানুষের মাথা, মুখাকৃতি, দেহের উচ্চতা, চামড়ার রং, চুলের রং, ঠোঁট, নাকের গড়ন, কান ইত্যাদি।

মানব জাতির প্রধান চার ভাগ:

এসব বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা সমগ্র মানব জাতিকে প্রধান চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-

  • (১) মঙ্গোলয়েড নৃ-গোষ্ঠী
  • (২) নিগ্রোয়েড নৃ-গোষ্ঠী
  • (৩) ককেশয়েড নৃ-গোষ্ঠী
  • (৪) অষ্ট্রালয়েড নৃ-গোষ্ঠী।

মোঙ্গলীয় মহাজাতি

ঐতিহাসিকবিদ, নৃ-তত্ত্ববিদ এবং গবেষকদের মতে অন্যান্য মঙ্গোলীয়ানদের মতো এদের গায়ের রঙ, মুখের অবয়ব এবং ঐতিহ্য, প্রথা, রীতিনীতি, সংস্কৃতি তথা জীবন প্রণালি অনুসারে গারোরা প্রাচীন মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বড়ো সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। এরা মোঙ্গলীয় মহাজাতি সত্তার তিব্বতী-বর্মণ জাতিগোষ্ঠীর, বোড়ো  শাখাভুক্ত।

এদের মাথা ও মুখমণ্ডল গোলাকার, চুল ও চোখ কালো, কপাল চোখের দিকে কিছুটা বাড়ানো, ভ্রূ ঘন, চোখ ছোট, শ্মশ্রূহীন, গায়েও লোম কম, নাকমুখ চেপ্টা, চোয়াল উঁচু, নাসারন্ধ্র মোটা, প্রশস্ত বুক, হস্ত-পদ-পেশি স্থূল, শরীর সবল, আকৃতি বেঁটে, চামড়া পীতাভ মসৃণ। তবে এই জনজাতির নাম গারো কেন হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। এ বিষয়ে এই চ্যাপ্টারের শেষের দিকে আলোচিত হয়েছে |

মোঙ্গোলীয় জাতি

ভারতবর্ষে মোঙ্গলীয় প্রবেশ

নৃ-তত্ত্ববিদদের মতে ভারতবর্ষে মোঙ্গলীয় প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী তিব্বত, ভুটান, নেপাল, সিকিম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে। ভারতে প্রবেশকারী মোঙ্গলীরা নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হয়, এদের একটি শাখা প্রথমে তিব্বতের তুরা প্রদেশে ও ভুটানের নকলবাড়ি নামক অঞ্চলে বসতি শুরু করে। এই শাখাকেই ভারতবর্ষে গারোদের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গারো নামের বিবর্তন

তিব্বত ও ভুটান থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা বিতারিত হয়ে গারোরা কোচবিহার, আসাম ও রংপুরের রাঙ্গামাটি, গোয়ালপাড়াতে আশ্রয় নেয়। গোষ্ঠীগত কলহে এদের একটি দল গোয়ালপাড়া ত্যাগ করে জনশূন্য, জঙ্গলাকীর্ণ, বৃষ্টিবহুল দুর্গম গারো পাহাড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। অনেকেই মনে করেন, গারো পাহাড়বাসী বলে এদের তখন নাম হয় গারো।

উল্লেখ্য ৩,০০০ বর্গমাইল আয়তনের এই পাহাড়টি বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটিশরা এই পাহাড়কে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এরা এই অঞ্চলে পাহাড়ে জুমচাষ, পশুপালন, শিকার ইত্যাদি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো।

Wikipedia, the free encyclopedia তে উল্লেখ রয়েছে, They are mainly distributed over the Kamrup, Goalpara & Karbi Anglong Districts of Assam, Garo Hills In Meghalaya, and substancial numbers are found in Mymmensingh district of Bangladesh.

ভৌগোলিক পরিবর্তন

কালক্রমে গারোরা বাসস্থানের বিচারে দুভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভাগ দুটি হলো− সমতলবাসী ও পাহাড়ী।

অধিকাংশ নৃ-তত্ত্ববিদগণ তাদের গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, এই অরণ্যচারী মানুষের পেশা ছিল মূলত পশু শিকার। তাঁরা গাছের বাকল পরত। পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে তাদের উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত থাকতো।

তাই গারোদেরকে তাদের চালচলন, সাজপোশাক, কথাবার্তা দেখে স্বাভাবিক মানুষ বলে মনেই করেন নি। জনশ্রুতি রয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে মোগলরা গারোদের ওরাংটাং মনে করতেন, ব্রিটিশরা পাহাড়ি গারোদের বলতেন অসভ্য ও বর্বর।

মোগল সেনাপতি মির্জা নাথন গারোদের সম্পর্কে যা বলেছেন তা আরো বিব্রতকর।

তাঁর ভাষায়- লোহা ছাড়া সবই গারোদের খাদ্য। তবে এদের টোটেম বিড়াল ব্যতিত এরা সব প্রাণীই খায়। সুপ্রাচীন অতীত থেকে এরা বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্গম পাহাড়ের অভ্যন্তরে নিজস্ব ভৌগলিক বলয়ে নিজস্ব প্রথা শাসিত স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করত। এদের রাজাহীন গোত্রপতি নিয়ন্ত্রিত সমাজ ছিলো।

১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত মেজর প্লেফেয়ারের The Garos নামক গ্রন্থে গারোদের সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, The earliest written records about the Garo dates from around 1800. They were looked upon as bloodthirsty savages, who inhabited a tract of hills covered with almost impenetrable jungle, the climate of which was considered so deadly as to make it impossible for a white man to live there. The Garo had the reputation of being headhunters।

বাংলাদেশের আদিবাসী

বাংলাদেশে ২৫ লক্ষাধিক আদিবাসী বসবাস করে। দেশে মোট ৪৫টিরও বেশি আদিবাসী জাতিসত্ত্বা বাস করে। গারো গবেষক, লেখক সুভাষ জেংচাম তাঁর গারোদের সমাজ ও সংস্কৃতি গ্রন্থে আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৫০টি বলে উল্লেখ করেছেন।

সেগুলো হলো গারো, চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, রাখাইন, ত্রিপুরা, হাজং, ডালু, চাক্‌, তঞ্চংগা, পাংখু, পাহাড়িয়া, পাহান, খাড়িয়া, খুমি, খাসি, খিয়াং, ক্ষত্রিয়, বর্মন, অহমিয়া/আসাম, মাহালী, মালো, রাজবংশী, উড়াঁও, কোচ, কর্মকার, কোল, খন্ড, গন্ড, গুর্খা, তুরী, পাত্র, বানাই, বাগদি, বিদিয়া, ম্রো, মনিপুরী, মুন্ডা, মাহাতো, মুসহর, মরিয়ার, রাই, রাজুয়ার,  লুসাঁই, সিং ইত্যাদি।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহায়তায় সারাদেশে অনুসন্ধান চালিয়ে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস গত ২৮ নভেম্বর ২০১০ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের উদ্দেশ্য তাদের সুপারিশ তুলে ধরে। আদিবাসী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বিষয়ক সুপারিশমালা শীর্ষক বক্তব্যে ককাস ৭৫টি ভাষিক সংখ্যালঘু জনজাতির তথ্য প্রকাশ করেছিলো।

এই ৭৫টি আদিবাসী জাতিসমূহ হচ্ছে;

  • ১) অধিকারী,
  • ২) অসম/অহম/অহমীয়া,
  • ৩) ওঁরাও/উঁরাও,
  • ৪) কন্দ/ কন্ধ/খন্দ কড়া,
  • ৫) কাউর,
  • ৬) কুর্মি/মাহতো,
  • ৭) কর্মকার,
  • ৮) কড়া/করোয়া,
  • ৯) কর্নিদাস,
  • ১০) কোচ,
  • ১১) কোল,
  • ১২) খারিয়া/খেরিয়া,
  • ১৩) খুমি/খামি,
  • ১৪) খিয়াং,
  • ১৫) খাসি,
  • ১৬) খারওয়ার,
  • ১৭) গন্ড/গন্ডি/গঞ্জু,
  • ১৮) গড়াইৎ/গড়াত,
  • ১৯) গারো,
  • ২০) গোর্খা,
  • ২১) গৌড়,
  • ২২) চন্ডাল,
  • ২৩) চাকমা,
  • ২৪) চাক,
  • ২৫) ছত্রী,
  • ২৬) ডালু,
  • ২৭) ডোম,
  • ২৮) ত্রিপুরা/টিপরা
  • ২৯) তঞ্চগ্যা,
  • ৩০) তুরি/তুরিয়া,
  • ৩১) তেলী,
  • ৩২) নুনিয়া,
  • ৩৩) পল্ল/পলিয়া,
  • ৩৪) পাত্র,
  • ৩৫) পাহান,
  • ৩৬) পাহাড়িয়া,
  • ৩৭) পাংখু/পাংখোয়া,
  • ৩৮) পুন্ড্র/পোদ,
  • ৩৯) বম,
  • ৪০) বর্মণ,
  • ৪১) বাউরি,
  • ৪২) বাগদী/বাকতি,
  • ৪৩) বানাই,
  • ৪৪) বাড়াইক,
  • ৪৫) বাদিয়া/বেদিয়া,
  • ৪৬) বীন/বিন্দ,
  • ৪৭) বোনাজ/বুনা
  • ৪৮) ভর,
  • ৪৯) ভূমিজ,
  • ৫০) ভূঁইয়া,
  • ৫১) ভূঁইমালী,
  • ৫২) মারমা,
  • ৫৩) মারমি/মুরমি,
  • ৫৪) মালো/মাল,
  • ৫৫) মাহালী,
  • ৫৬) মাহাতো,
  • ৫৭) মনিপুরী,
  • ৫৮) মিরধা,
  • ৫৯) মুন্ডা,
  • ৬০) মুরারি/মুরিয়ারি,
  • ৬১) মুষহর,
  • ৬২) ম্রো/মুরং,
  • ৬৩) রাওতিরা,
  • ৬৪) রবিদাস,
  • ৬৫) রাখাইন,
  • ৬৬) রাজোয়াড়,
  • ৬৭) রাই,
  • ৬৮) রাজবংশী,
  • ৬৯) রানা-কর্মকার,
  • ৭০) লুসাই,
  • ৭১) লোহার/লহরা,
  • ৭২) শবর,
  • ৭৩) সাউ,
  • ৭৪) সান্তাল/সাঁওতাল
  • এবং ৭৫) হাজং।

ককাসের তথ্য অনুযায়ী, এই জনজাতিসমূহের লোকসংখ্যাও প্রায় ২৫ লাখ।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

সর্বশেষ মন্তব্য